১৬ বছর বয়সী রূপালী খাতুন সে জন্মগত বাকশ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষ। রূপালী নড়াইল সদরের মাইজপাড়া ইউনিয়নের তারাশি গ্রামের (দক্ষিণ পাড়া) টুকু মিয়া শেখের (৪২) কনিষ্ঠ কন্যা। তার মা রিক্তা বেগম গৃহিণী। রূপালীরা দুই ভাই দুই বোন। এরমধ্যে রূপালী খাতুন (১৬) সবার ছোট। বোন সোনালী খাতুন (১৮) ১০ম শ্রেণিতে লেখা-পড়া করে, ভাই মুস্তাকিন শেখ (২০) ও লাল চান মিয়া শেখ (২২) কৃষি কাজ করে। রূপালীর বাবার বসতভিটা ছাড়া আর কোন জায়গা-জমি নেই। অন্যের জমি-জমা বর্গা নিয়ে চাষবাস করেন। কৃষির ওপর নির্ভর করে ৬জনের সংসার।
বুধবার (২৬ এপ্রিল) সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় দুইটি ঝুপড়ি ভাঙ্গাচুরা ঘরে বসবাস ৬ সদস্যের এই পরবিার। রূপালী যে ঘরটিতে থাকে সেখানে তার বোন সোনালীর পড়ার টেবিল, ১টি টেলিভিশন এবং ওই পড়ার টেবিলেই চলে তাদের সাজগোজের কাজ।
প্রতিবেশি থেকে জানাযায়, প্রতিদিনের চাওয়া পাওয়ার কাজ চলে ইশারায়। রূপালী কবুতরকে খুব ভালোবাসে। ঝুপড়ি ঘরের পাশে বাবা-মা প্রতিবন্ধী মেয়ের সখ পুরণের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন কবুতরের একটি ঘর। প্রতিদিন সকাল-বিকালে সে ইশারায় খাবার ছড়িয়ে কবুতর ডাক দেয় আর মিট মিট হাসি দেয়।
রূপালীর মা রিক্তা বেগম বলেন, আমার গর্ভে প্রতিবন্ধী মেয়ে জন্ম হওয়ায় আমি একটুও কষ্ট পাইনি। এমন কি আমার প্রতিবেশি বা শশুর বাড়ির লোকজনও আমাকে কষ্ট দেয়ার মতো কথা বলেনি কখনও। আমরা চেষ্টা করেছি লেখা-পড়া করানোর জন্য। কিন্তু লেখা-পড়া করানোর তেমন পরিবেশ পাইনি। আমার মেয়ে রূপালী টেলিভিশনে নাচ দেখে দেখে সে এখন ভালো নাচতে শিখেছে। সে প্রতিবছর ২৬ শে মার্চসহ এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খেলা-ধুলাইসহ অন্যান্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং সে একটা না একটা পুরস্কার নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। তখন আমার কতো যে ভালো লাগে তা ভাষায় বলতে পারবো না। আমি আমার মেয়ের জন্য গর্বিত যে সে প্রতিবন্ধী হয়ে আমার গর্ভে জন্ম নিলেও সে অন্য ৫ জন সুস্থ্য ও স্বাভাবিক মানুষের মতই আমাকে ভালোটা দিয়ে যাচ্ছে। এতে করে আমি মনে করি প্রতিবন্ধী মানুষ পরিবারের কোন বোঝা নয়, বরং তাকে উপযুক্ত পরিবেশ দিয়ে গড়ে তুলতে পারলে সে পরিবার, সমাজ ও দেশের সম্মান রক্ষাসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতা করতে পারে। তার এ সাফল্যের কারনে এলাকার প্রত্যেকেই তাকে ভালোবাসেন।
রূপালীর পথচলা যেভাবে শুরু হয় সে সম্পর্কে তার বাবা টুকু মিয়া জানান, আমার মেয়েকে নড়াইল শহরে সিকদার ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিও’এর পরিচালক মনজুরুর রহমান পান্নু সিকদার প্রথমে আমাদের এই তারাশি গ্রামে আসেন। তিনি এ গ্রামে এসে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পাওে যে, আমার একজন প্রতিবন্ধী মেয়ে আছে। বাড়িতে এসে তিনি আমার মেয়ের কাজ-কাম লেখা-পড়া সম্পর্কে জানতে চায়। মেয়ে কি কি করতে পারে। আমি তাকে আমার মেয়ের সম্পর্কে বিস্তারিত খুলে বলি। এরপর তিনি আমার মেয়েকে বাড়ির পাশে মরাচিত্রা নদীতে সাঁতার শেখাতে থাকেন। আমার মেয়ে নিয়মিত এ নদীতে সাঁতার শিখতে থাকে। এক পর্যায় পান্নু ভাই আমার রূপালীকে খুলনায় এবং পরে ঢাকাতে সাঁতার কোচিংএ সুযোগ করে দেন। সেখান থেকে আমার মেয়ে সাঁতার শিখে দেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
তিনি আরও জানান, আমার মেয়ে এ কয়েক বছরে দেশের ভেতর ৭টি সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। তারমধ্যে ৬টিতেই সে প্রথম হয়েছে মাত্র ১টিতে সে ২য় হয়। এভাবেই আজ আমার মেয়ে স্পেশাল অলিম্পিক বাংলাদেশ কর্তৃক এ্যাথলেট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ‘স্পেশাল অলিম্পিক সামার ওয়ার্ল্ড গেমস ২০২৩’ এ জার্মানিতে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে।
সিকদার ফাউন্ডেশনের পরিচালক মনজুরুর রহমান পান্নু জানান, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ শুরু হয় নড়াইলের স্বাবলম্বীর নির্বাহী পরিচালক কাজী হাফিজুর রহমানের প্রচেষ্টায়। আমি তার বুদ্ধি-পরামর্শে অর্টিজমদের নিয়ে কাজ শুরু করি। এর মধ্যদিয়ে স্পেশাল অলিম্পিক বাংলাদেশ কর্তৃক এ্যাথলেট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ‘স্পেশাল অলিম্পিক সামার ওয়ার্ল্ড গেমস ২০২৩’ অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। এই প্রতিযোগিতা জার্মানির বার্লিন শহরে ১২ জুন থেকে ২৫ই জুন ২০২৩ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। তবে এর আগে বাংলাদেশে এদের দেড় মাসের মতো প্রশিক্ষণ চলবে তারপর বিভিন্ন ইভেন্টসের সমন্বয় একটি টিম ‘স্পেশাল অলিম্পিক সামার ওয়ার্ল্ড গেমস ২০২৩’ জার্মানির বার্লিনে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হবে।
জানাগেছে, কিংবদন্তি ক্রিকেটার মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার ইউনিয়ন মাইজপাড়ার তারাশি গ্রামের মেয়ে রূপালী খাতুন, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের নিজ জেলার ১জন, সিলেট জেলার সন্তান বর্তমান নড়াইল জেলার ডিসি মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী’র জেলার ১জনসহ মোট ৪ জন ‘স্পেশাল অলিম্পিক সামার ওয়ার্ল্ড গেমস ২০২৩’ সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন।