• 03 May, 2024

নির্বাচনে ভার্চুয়ালি গুজব মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জ ও তৎপরতা

নির্বাচনে ভার্চুয়ালি গুজব মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জ ও তৎপরতা

যে কোনো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে অপতৎপরতা চালায় একটি চক্র। তবে ভার্চুয়াল মাধ্যমের প্রসার হওয়ায় এখন গুজব আগের তুলনায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মানুষের কাছে।

অনেকে না বুঝে বিশ্বাসও করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা ধরনের গুজব ছড়ানোর শঙ্কাও করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবার ভার্চুয়ালি গুজব প্রতিরোধ অনেকটা চ্যালেঞ্জের হবে বলে মনে করছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।

ভার্চুয়াল জগতে নজরদারি করতে সকল থানায় একজন বিশেষায়িত কর্মকর্তাও কাজ করছেন। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে গুজব ছড়াবে তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে, বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।  

ময়মনসিংহ জেলার পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞা সাংবাদিকদের একটি অনুষ্ঠানে বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি চক্র কুতথ্য, গুজব ও অপ্রচার চালিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাসিলের চেষ্টা করে। বিগত জাতীয় নির্বাচনে দেশের কয়েকটি এলাকায় গুজব ছড়িয়ে সহিংসতার ঘটনা তুলে ধরেন তিনি। পুলিশ সুপার বলেন, গুজবের কারণে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সতর্ক থাকার পাশাপাশি গুজব, অপপ্রচার প্রতিরোধে দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ভার্চুয়াল জগতে বাড়ছে গুজবের সংখ্যা। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করতেই এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে মনে করছেন তথ্য যাচাইকারীরা। গুজব ছড়ানো হচ্ছে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে। যার বেশিরভাগই রাজনৈতিক গুজব। গুজব রোধে ব্যক্তি সচেতনতা, সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন করা ছাড়াও পাঠ্যপুস্তকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নিয়মাবলি যুক্ত করাও প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে। গুজব প্রতিরোধে প্রতি থানায় একজন করে বিশেষায়িত কর্মকর্তা কাজ করছেন বলে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত গুজব ছড়িয়ে এ জেলায় কোনো বৃহৎ ঘটনার কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে। তবে সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও নজরদারি রেখেছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে।  

র‌্যাব-১৪ ময়মনসিংহের অধিনায়ক মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম ইসলাম খান বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ গুজব ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে কী না এ ব্যাপারে সবসময়ই আমাদের নজরদারি থাকে। সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাইবার মনিটরিংয়ে আরও বেশি নজরদারি থাকবে। অনলাইন মাধ্যমে যারাই গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করবে তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা হবে।  dhakapost

আগে নির্বাচন কেন্দ্রিক কি ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়তো ও বর্তমানে কি ধরনের গুজব ছড়ানোর শঙ্কা করছেন এমন প্রশ্নে সামাজিক সংগঠন ‘জনউদ্যোগ’ ময়মনসিংহের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, আগে বিভিন্ন কানকথার মাধ্যমে গুজবের ডালাপালা মেলত এবং এ নিয়ে কেন্দ্রে কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা তৈরি হত। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহজলভ্য হওয়ার কারণে অনেক ধরনের গুজব সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ এগুলো বিশ্বাসও করছে। যেমন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে- এমন তথ্য ছড়িয়েছিল যার কোনো ভিত্তি বৈজ্ঞানিকভাবেও নেই এবং ধর্মীয়ভাবেও নেই। তবুও মানুষ এটি বিশ্বাস করেছে। এতে দাঙ্গাহাঙ্গামা বেধেছে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে গুজব নিয়ন্ত্রণ করা হবে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং।

তিনি আরও বলেন, এই বিষয়টি দেখার দায়িত্ব যাদের তাদেরকে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। কেউ গুজব সৃষ্টি করলে সাইবার টিম যাতে সেগুলো দ্রুতই শনাক্ত করতে পারে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তা মুছে ফেলার ব্যবস্থা করতে পারে এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। একই সঙ্গে কোনো বিষয়ে এমন একটি সরকারি সাইট তৈরি করা যেতে পারে যেখানে ফেক্ট চেকের মাধ্যমের মানুষ সত্যটা জেনে বিভ্রান্ত দূর করতে পারবে। সে বিষয়ে সরকার নজর দিলে আশা করি গুজব প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

গুজব প্রতিরোধের বিষয়ে ময়মনসিংহের সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গুজবের বিষয়টি আমরা পুলিশের মাধ্যমে মনিটরিং করে থাকি। সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে তদারকি করতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। এ ছাড়া অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে এ ব্যাপারে কোনো রিপোর্ট পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গুজব নিয়ন্ত্রণে বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয় 

রাজনৈতিক উদ্দেশে নির্বাচনের সময় গুজবের ডালাপালা আরও বেশি করে ছড়ানোর আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি) এর সহকারী অধ্যাপক তানভীর হাসান জোহা। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এটা পরীক্ষিত। শুধু বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নয়, বহির্বিশ্বের ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হয় সেখানেও বিভিন্ন উপায়ে সাইবার অপরাধ, গুজবের ঘটনা ঘটে থাকে। আর যেহেতু বাংলাদেশের নির্বাচনে অনেক দলের অংশগ্রহণ আছে, আবার নেই এবং নানা রকম তর্কবিতর্ক আছে। সেখানে অনেকে সাইবার মাধ্যমে বিক্ষিপ্ত সংবাদ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার উদাহরণও রয়েছে

সম্প্রতি মেয়র নির্বাচন এবং সংসদ সদস্য মারা যাওয়ার পর তাদের আসনে উপনির্বাচনে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা যা দেখতে পেয়েছি- পুরোনো কিছু ফুটেজ ব্যবহার করে বর্তমান নির্বাচনে ব্যবহার করে একটি সাময়িক উত্তেজনা তৈরি করা হয়েছে। যেমন পুরোনো কোনো নির্বাচনে জাল ভোট দিচ্ছে এমন ফুটেজ এই নির্বাচনে চলছে, এমন বিষয় দেখানো হচ্ছে। এতে সঠিক ভোট হলেও মানুষ তথ্য বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। 

জোহা আরও বলেন, নতুন একটা আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছি। সেটা হচ্ছে ডিপফেক অর্থাৎ এআই এর মাধ্যমে ভিডিও তৈরি করা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ভিডিও তৈরির মাধ্যমে অসত্য স্থাপন করা একটা নতুন ধরনের গুজব। এতে মানুষ খুব সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারে। এই প্রযুক্তি যদি এবারের নির্বাচনে ব্যবহৃত হয় তাহলে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পরবে। এক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর একটি নীতিমালা করা প্রয়োজন। ডিজিটাল প্লাটফর্মে আমরা কীভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবো সেটা তাদের বের করতে হবে। 

dhakapost

অনেক সময় দেখা যায় নির্বাচনের সময় নেট স্লো করে দেওয়া হয়। এতে যারা ব্যবসা করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি আল্টিমেট কোনো সমাধান নয়। এজন্য আমাদের অ্যাকাডেমিক উপায়ে ভুয়া নিউজকে মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে নীতিমালা প্রণয়ন ও আইনীভাবে এটার প্রয়োগ করতে হবে। 

আমি আশা করেছিলাম সাইবার নিরাপত্তা আইনে ফেক নিউজের ব্যাপারে একটা আলাদা আইন হবে। যদিও সেখানে আংশিক কভার হয়েছে অপপ্রচারের বিষয় কিন্তু ফেক নিউজ ও অপপ্রচার দুইটি ভিন্ন বিষয়। সুতরাং ফেক নিউজের বিষয়টা আইনে ব্যাখ্যা করে আলাদা আইন বা নীতিমালা করতো তাহলে এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো কঠোর হস্তে দমন করা যেত। 

একই সঙ্গে একটি মনিটরিং সেল করতে হবে। শুধু নামে মনিটরিং সেল নয়। কার্যত দৃশ্যমান মনিটরিং সেল করতে হবে। তারা প্রযুক্তিগত অপরাধগুলো মোকাবিলা করবে। এক্ষেত্রে আলোচনা বা নিউজ করে কোনো সমাধান হবে না যদি না ওই প্রযুক্তিটা তাদের ব্যবহার করার সুযোগ না দেওয়া হয়। 

এখন যেটা হয়, মনিটরিং সেল একটা জিনিস দেখে তারপর তারা যাচাই বাছাই করে কারিগরি কমিটির কাছে দেয়, পরবর্তীতে কারিগরি কমিটি সেটি বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে করে কালক্ষেপণ হওয়ার কারণে ওই ফেক নিউজটি চারপাশে ব্যাপ্তি হয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়ে যায়। এ সংক্রান্ত মামলা হলেও সেটার অগ্রগতি খুবই ক্ষীণ। এতে করে বিচার না হওয়ায় তারা স্বার্থ চরিতার্থের জন্য একই কাজ আবারও করে। 

কেন্দ্রীয়ভাবে গুজব মনিটরিং এর জন্য ব্যবস্থা সরকারের আছে। কমিটির টিম আছে। তারা ফেসবুকের সঙ্গেও কাজ করে। কার্যত তারা দৃশ্যমান হলেও একটু স্থূল। তারা কোনো ফ্রন্ট অ্যাকশনে যেতে পারে না। এটা একটা বড় সমস্যা। 

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগও নামেমাত্র একটি কমিটি করে রেখেছে। যেকোনো একটি পেইজ বন্ধ করে দেওয়ার সক্ষমতা তাদের আছে কিন্তু এক্ষেত্রে নীতিমালাগত কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এইজন্য প্রয়োজন আইন ও আইনের প্রয়োগ এবং নীতিমালা প্রণয়ন।