• 17 May, 2024

শারদীয় দুর্গোৎসব সাতক্ষীরায় প্রস্তুত ৬০৬টি পূজা মন্ডপ

শারদীয় দুর্গোৎসব সাতক্ষীরায় প্রস্তুত ৬০৬টি পূজা মন্ডপ

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: দুয়ারে কড়া নাড়ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।এজন্য শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত প্রতিমা শিল্পীরা।সাতক্ষীরা জেলার ৬০৬টি মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে দুর্গাপূজার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।ব্যস্ততায় যেন দম ফেলার ফুরসত নেই প্রতিমা শিল্পীদের।তাদের নিপুণ হাতে তৈরি হচ্ছে দুর্গা, গণেশ ও কার্তিকসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা।

আগামী ২০ অক্টোবর(শুক্রবার)মহাষষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে ৫দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হবে।সাতক্ষীরা সদরসহ জেলার অধিকাংশ মন্দিরে চলছে তারই প্রস্তুতি।ভাস্কররা ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমার সৌন্দর্য বর্ধনে। দুর্গাপূজার বাকি মাত্র ৩ দিন।দুর্গোৎসবকে পরিপূর্ণভাবে সাজাতে মন্দিরগুলোতে দিনরাত চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। তারমধ্যে সদরের মন্দিরগুলোতে চলছে প্রতিমা তৈরীর ধূম।

এ বছর সাতক্ষীরা জেলায় ৬০৬ টি মণ্ডপে উদযাপিত হবে শারদীয় দুর্গোৎসব।শারদীয় দূর্গাপূজা সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করার জন্য প্রতিটি পূজা মন্ডপকে বাধ্যতামূলক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে।তাছাড়া সরকার নির্দেশিত সকল বিধিনিষেধ মেনে এবারের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে বলে জেলা পূজা উদযাপন প‌রিষদের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।এবছর দুর্গোৎসবে যে কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে তিনস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।

সাতক্ষীরা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা যায়,এ বছর জেলার ৭টি উপজেলায় ৬০৬টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে।তারমধ্যে সাতক্ষীরা সদর ১১২টি,কলারোয়া উপজেলার ৪৮টি,তালা ১৯৬টি,আশাশুনি ১০৮টি,দেবহাটা ২১টি,কালিগঞ্জ ৫১টি ও শ্যামনগরের ৭০টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে।

সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন মন্ডপে ঘুরে প্রতিমা শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি প্রতিমা তৈরি করতে শিল্পীদের সর্বনিম্ন ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। সর্বোচ্চ তিন-চার লাখ টাকা খরচ হচ্ছে এ বছর।প্রতিমা তৈরির জন্য তাদের ৩ থেকে ৪ ভ্যান মাটি লাগে,খড়ের আউর লাগে ৫ থেকে ৬ পৌন।এছাড়াও কাঠ,বাঁশ,দড়ি,পেরেক,সুতা ও ধানের গুড়াসহ বিভিন্ন জিনিসের প্রয়োজন হয়।এর মধ্যে প্রতি ভ্যান মাটিতে তাদের খরচ হয় ৬শ'- ৮শ' টাকা,প্রতি পৌন আউরে খরচ হয় ৫শ'- ৬শ' টাকা।আর বাকি জিনিসগুলোর জন্য খরচ হয় ৪-৫ হাজার টাকা।আগের থেকে সব কিছুর জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় একটু বিপাকে আছি।

তারা আরও জানান,একটি প্রতিমা তৈরি করতে সময় লাগে গড়ে ১০-১২ দিন।প্রতিমা তৈরিতে ৪-৫জন শিল্পী একসঙ্গে কাজ করেন।একেকজন শিল্পী প্রতিমার এক এক কাজে হাত দেন বলেও জানান প্রতিমা শিল্পীরা।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্যাংদহা এলাকার প্রতিমা শিল্পী সদেব বাছাড় বলেন, ৪বছর ধরে প্রতিমা তৈরি করি।এ বছর ৬টি প্রতিমা তৈরি করছি।মাটির কাজ শেষ করেছি এখন রং তুলির কাজ করছি।বর্তমানে খড়,বাঁশ,মাটি,লোহাসহ সব কিছুর দাম আগের তুলানায় অনেক বেশি।সব কিছুর দাম বাড়ার কারণে আমাদের এখন পোষে না।

এবছর দেবীর আগমন ও গমন দুটোই ঘোটকে।যা অশুভ ইঙ্গিত।শাস্ত্রমতে বলা হয় সপ্তমীতে দেবী দুর্গার আগমন এবং দশমিতে গমন হয়।সাধারণত প্রতি বছর সপ্তমী ও দশমী কী বার পড়ছে তার ওপর নির্ভর করে দেবীর কিসে আগমন এবং গমন সেটা বোঝা যায়।

ভক্তরা জানান,এবার দেবীদুর্গা আসবেন ঘোড়ায় চড়ে,আর ফিরবেনও ঘোড়ায়। ঢাক,ঢোল, শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনি দিয়ে দেবীদুর্গাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তারা।প্রতিটি পূজা মণ্ডপে প্রতিমা বানানোর কাজ শেষ।এখন রঙ তুলির আঁচড়ে চলছে শেষ সময়ের প্রস্তুতি।ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রতিমার কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন।নিখুঁতভাবে মনের মাধুরি মিশিয়ে তারা প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন।আর এক একটি  মণ্ডপে প্রতিমা তৈরিতে কারিগররা মজুরি নিচ্ছেন ৬০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত।একইসঙ্গে পূজার পুরোহিত নির্বাচনের কাজও শেষ করছেন মণ্ডপ পরিচালনা কমিটি।

শরতের শিশির ভেঁজা কাঁশফুলই শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা দেয়।গত শনিবার(১৪ অক্টোবর) শুভ মহালয়া মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব।দুর্গোৎসব ঘিরে নানা আয়োজনে ব্যস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে সব ধর্ম ও শ্রেণির বাঙালির মধ্যেও।পূজার আনন্দে মাতোয়ারা বাঙালি জাতি।মন্দিরে মন্দিরে চলছে প্রতিমা সাজসজ্জার কাজ।দেবী মূর্তি নির্মাণ শেষ,গায়ে রঙ ছোঁয়ানোর অপেক্ষায় দক্ষ ভাস্কর,নিপুণ শিল্পী।ধূলোবালি লেগে নষ্ট হয়,তাই কাপড়ের পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে প্রতিমাগুলোকে। আয়োজকরা ছুটছেন দর্জিপাড়ায়।মা দুর্গার লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ির জরির কাজ, গণেশের ধুতিতে নকশাদার পাড় বসানো আর মহিষাসুরের জমকালো পোশাক তৈরির কাজ। কেউবা ছুটছেন কামারপাড়ায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বানিয়ে নিচ্ছেন দেবীর হাতের চক্র,গদা,তীর-ধনুক ও খড়গ-ত্রিশূল আর ভীষণ ঘষামাজায় মিস্ত্রিরা ব্যস্ত মণ্ডপ গুলোকে নতুন রূপে সাজিয়ে তুলতে।ডেকোরেটর কর্মীদের ঘুম নেই।আয়োজকদের ফরমায়েশ আর ডিজাইন অনুযায়ী গড়ে তুলছেন পূজামণ্ডপ।চলছে সংস্কারের শেষ কাজটুকু। দুর্গার বাহকসহ প্রতিমার শাড়ি ও অলংকার পরানোর কাজও ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। আলোকসজ্জা ও রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হচ্ছে প্রতিটি মণ্ডপ।প্রতিমা দেখতে এখনই দর্শনার্থীরা মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

প্রতিমা তৈরী ও মন্দিরের সাজসজ্জার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।আগামী ১৯ অক্টোবর মহাপঞ্চমীতে সায়ংকালে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব।২০ অক্টোবর শুক্রবার মহাষষ্ঠীতে দুর্গাদেবীর ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠী বিহিত পূজা এবং সায়ংকালে দেবীর বোধন,আমন্ত্রণ ও অধিবাস।২১ অক্টোবর মহাসপ্তমীতে নবপ্রত্রিকা প্রবেশ,সপ্তমী বিহিত পূজা এবং দেবীর ঘোটকে আগমন।২২ অক্টোবর মহাষ্ঠমীতে দুর্গা দেবীর অষ্টমী বিহিত পূজা।২৩ অক্টোবর মহানবমীতে বিহিত পূজা এবং ২৪ অক্টোবর মঙ্গলবার বিজয়া দশমীতে বিহিত পূজা সমাপন ও বিসর্জন,বিজয়া দশমী কৃত্য ও দেবীর ঘটকে গমন।

হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে দুর্গোৎসব বিবেচিত হলেও বর্তমানে তা বাঙালি উৎসবে পরিণত হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশ শিল্পের হাতের নকশায় এবং রং তুলির ছোঁয়ায় তৈরী হচ্ছে দেবী দুর্গার প্রতিমা। ইতোমধ্যে দেবী দুর্গার আগমনী বার্তায় বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে উৎসবের আমেজ বইতে শুরু করেছে। সকল পূজা মন্দিরগুলোতে চলছে প্রতীমা নির্মাণ ও মন্দিরের সাজসজ্জার কাজ। পরবর্তীতে রং তুলির ছোঁয়ায় দশভুজা ষষ্ঠীতে পাবে জীবন্ত রূপ। দেবী সেজে উঠবে অপরূপ সাজে। শঙ্খ উলুধ্বনি আর মঙ্গল সঙ্গীতে দেবী দুর্গাকে বরণ করে নেবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। জাতির মঙ্গল কামনায় সব অশুভ শক্তি বিনাশে প্রতিবছর মহালয়ার দিনে দেবী দূর্গা শ্বশুরালয় থেকে পিতৃগৃহে আগমন করেন। আসুরিক শক্তির বিনাশ আর পার্থিব শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি লাভের জন্য হিন্দু সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে মা দূর্গার আরাধনা করে আসছেন। এদিকে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনসাধারণের সহযোগিতায় শারদীয় দুর্গাপূজা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জেলাবাসী।

সাতক্ষীর জেলা মন্দির কমিটির সভাপতি বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন,শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপনের লক্ষ্যে তাদের সকল প্রস্তুতি শেষের দিকে।গত সোমবার( ২ অক্টোবর) জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আসন্ন দুর্গাপূজা নিয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশে সাথে আলোচনা সভা শেষ হয়েছে।তবে এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে যে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে তারা আন্তরিকভাবে কাজ করলে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না।এ বছর উৎসবকে শান্তিপূর্ণভাবে করতে প্রতিটি পূজা মন্ডপকে বাধ্যতামূলক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে।এছাড়া  প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি মণ্ডপের নিজস্ব সেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করবে।জেলার অতিগুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলোর তালিকা করে সেখানে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।

সাতক্ষীরা জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি সুভাস ঘোষ বলেন,এবছর জেলায় ৬০৬ টি মণ্ডপে উদযাপিত হবে শারদীয় দুর্গোৎসব।শারদীয় দূর্গাপূজা সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করার জন্য প্রতিটি পূজা মন্ডপকে বাধ্যতামূলক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পূজা উদযাপন কমিটির প্রস্তুতিমূলক সভায়।

শারদীয় দুর্গাপূজার নিরাপত্তার বিষয়ে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে জেলা পুলিশ সকল ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। যেকোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে আমরা সর্বদা সজাগ রয়েছি।সকল সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে তাদের উৎসব পালন করতে পারে সে বিষয়ে সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।এছাড়া দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় দ্বায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে।তাছাড়া এবছর নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিটা পূজা মন্ডল এলাকা সিসিটিভির আওতায় থাকবে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন,হিন্দু ধর্মালম্বীদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা।জেলায় এবছর ৬০৬ টি মন্ডপে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে।শারদীয় দূর্গাপূজা সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করার জন্য প্রতিটি পূজা মন্ডপকে বাধ্যতামূলক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে এবং যে কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে তিনস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।