• 14 Feb, 2025

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি - টাকার এপিঠ আর ওপিঠ : এ এইচ এম নোমান

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি - টাকার এপিঠ আর ওপিঠ : এ এইচ এম নোমান

"প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছেন, 'দেশের মানুষ ছাত্রদের ওপর ভরসা করে। এই বিশ্বাস ধরে রেখো। হাতছাড়া কোরো না। তোমরা কখনোই আশাহত হবে না। তোমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছ। দেশ বদলিয়ে ফেলেছ। তোমরাই পারবে।' স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার পরামর্শে তিনি বলেন, 'স্থানীয় সরকার সংস্কারের জন্য কমিশন আছে। তারা পরামর্শ দেবে আমরা কাজ করব"

মানুষ যেমন এক পায়ে হাঁটতে পারে না, এক হাতে যেমন তালি বাজে না, গরিবি ও শান্তিও একসঙ্গে হাঁটতে পারে না। এজন্য সংগত উপলব্ধি থেকেই অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জগদ্বাসীর কাছে প্রশ্ন রাখেন, কোনো রাষ্ট্রেই 'শান্তি মন্ত্রণালয়' নেই কেন? মানুষের আসল উদ্দেশ্য হলো পরার্থে জীবন যাপন করা। বিশ্বকে এক টুকরো শান্তির স্থান করে তোলা। রাজনৈতি-ভৌগোলিক স্বাধীনতা হলেও অর্থনৈতিক মুক্তি না হলে প্রকৃত স্বাধীনতা আসে না। এটা আমরা সবাই জানি। বরং হত্যা লুটতরাজ চুরি ডাকাতি দখলবাজি চাঁদাবাজি অশান্তি ঘুষ-দুর্নীতি দোষাদোষি অন্যায্যতা বাড়ে। চূড়ান্ত বিবেচনায় অসাম্যসহ বৈষম্য দিনদিন বৃদ্ধি পায়। গত জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন- বিস্ফোরণ তারই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।

একজন অর্থনীতিবিদ রাজনীতিমনস্ক অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অর্থনৈতিক মুক্তির পথ তৈরিকারী গরিবের ব্যাংকার ক্ষদ্রখাণ উদ্ভাবনকারী টেকসই কাঠামো প্রতিষ্ঠাকারী ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস ৮ আগস্ট ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বৈপ্লবিক বিজয়ীদের কর্তৃক নতুন বাংলাদেশের বিনির্মাণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেশসেবার কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। এই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর শীর্ষে অবস্থানটা অবশ্যই রাজনৈতিক। এই যে রাজনৈতিক শীর্ষে অবস্থান, প্রস্তাবিত রাষ্ট্র সংস্কার প্রত্যাশা, অবশ্যই গরিবের তথা সাধারণ জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে দেশ তথা সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক মুক্তির ভিত তৈরিই রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশাল স্বীকৃতি।

উত্তাল জুলাই-আগস্টের পরিবর্তনের লক্ষ্যে 'শোনো মহাজন, আমরা অনেকজন' দেওয়ালে যুব-জনতার শক্তির হাজারো গ্রাফিতিরই প্রতিধ্বনি। একইভাবে সারা দেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা সারা বিশ্বের, বিশেষ করে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের বাংলায় ভাষণ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ অনেক রাষ্ট্রপ্রধান- প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক সংস্থাপ্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব নিপীড়িতের, টাকার এপিঠ আর ওপিঠ, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির পথরেখা বিনিময় করেন।

আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতত্বকে বিভক্তি এড়িয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করার আহবান জানিয়েছেন। এক থিংকট্যাংক ও গবেষকের প্রশ্নোত্তরে তিনি বলেছেন, 'বাংলাদেশের জনগণ সাহসিকতার সঙ্গে একজন অজনপ্রিয় ও স্বৈরাচারী শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। এখন তাদের সামনে সুযোগ এসেছে বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন করার। এ সময়ে নতুন করে বিভক্তি এড়িয়ে, ব্যক্তির দিকে না তাকিয়ে দেশের দিকে তাকিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের পরিশ্রমী জনগণের প্রচেষ্টায় দেশটি সব দিক থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামনে বিরল সুযোগ এসেছে পুনর্গঠনের।' টেকসই গণতন্ত্রের জন্য তিনি আয় ও সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জোরারোপ করেন। তিনি একই সঙ্গে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ পরিবর্তন করার জন্যও কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানান।

18niujnoman-1.jpgঅর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশর অর্থনীতি স্থিতিশীলতায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো ইতিবাচক সাড়া দিতে শুরু করেছে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকসহ সবার কাছ থেকে ভালো সাড়া এসেছে। আমরা এমন পদচিহ্ন রেখে যেতে চাই, যাতে পরের সরকার এসে তা অনুসরণ করতে পারে। ভবিষ্যতে কেউ অর্থ পাচার করতে পারবে না। সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ, যে কোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা উন্নতি করা। নিরাপত্তার কিছু পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তা ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে অর্থনীতির শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে 'উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবায়ন' শিরোনামে বলেন, গত সরকারের উন্নয়ন-পদ্ধতিই দুর্নীতি-সহায়ক। পদ্ধতিই ছিল দুর্নীতি ও অনিয়মকে উৎসাহিত করা। শ্বেতপত্রে মোটা দাগে ছয়টি বিষয়-সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যব্যবস্থাপনা, বাণিজ্যিক ভারসাম্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান। দারিদ্র্য ও বৈষম্যসহ বিভিন্ন বিষয়েও দেখা যায় দেশে বৈষম্য বেড়েছে। ৪ থেকে ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিয়ে এই উন্নয়ন সম্ভব নয়। পাচারের টাকা ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সব সংস্থাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। তবে এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, 'আমাদের গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা যেভাবে তারা (গত সরকার) লুণ্ঠন করেছে, তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। শেখ হাসিনা সরকারের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর যে ভঙ্গুর অর্থনীতি আমরা পেয়েছি, তা এই রিপোর্টে উঠে এসেছে। জাতি এই নথি থেকে উপকৃত হবে।'

পত্রিকান্তরে আরো দেখা যায়, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) 'ক্যাডার' শব্দটি নেতিবাচক হওয়ায় বাদ দেওয়ার সুপারিশ করবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। মানুষ পরিবর্তন চায়, পরিবর্তনের জন্যই পরিবর্তিত সরকার এসেছে। 'জনপ্রশাসন' শব্দের বদলে 'জনসেবা' মন্ত্রণালয় হতে পারে। শুধু শব্দ পরিবর্তন করে কি কোনো পরিবর্তন হবে-এ প্রশ্নের উত্তরে সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, আসলে সবার মন ও মস্তিষ্কের পরিবর্তন করতে হবে। খেলাপি ঋণ, ঋণ অবলোকন, ঋণ পুনঃ তপশিল, ঋণ পুনর্গঠন এবং স্টে অর্ডার বা মামলায় আটকে থাকা দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের প্রেক্ষিতে শ্বেতপত্রের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি T টাকারও বেশি। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। আগামী বাজেট পর্যন্ত একটি অর্থনৈতিক স্থিতায়ন কর্মসূচি দরকার। ফলে এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। এর সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও যুক্ত করতে হবে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে আলাদাভাবে সংস্কারের যে বিভিন্ন পদক্ষেপ চলছে, এগুলোকে সময়-নির্দিষ্ট ও সমন্বিতভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস শিক্ষার উদ্দেশ্যে বলেছেন,"দেশের মানুষ ছাত্রদের ওপর ভরসা করে। এই বিশ্বাস ধরে রেখো। হাতছাড়া কোরো না। তোমরা কখনোই আশাহত হবে না। তোমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছ। দেশ বদলিয়ে ফেলেছ। তোমরাই পারবে।' স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার পরামর্শে তিনি বলেন, 'স্থানীয় সরকার সংস্কারের জন্য কমিশন আছে। তারা পরামর্শ দেবে আমরা কাজ করব। আমরা চাই, স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। খুব কম জিনিস উচ্চ পর্যায়ে থাকবে। দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেম, একবারমানুষ ছাত্রদের ওপর ভরসা করে। এই বিশ্বাস ধরে রেখো। হাতছাড়া কোরো না। তোমরা কখনোই আশাহত হবে না। তোমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছ। দেশ বদলিয়ে ফেলেছ। তোমরাই পারবে।' স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার পরামর্শে তিনি বলেন, 'স্থানীয় সরকার সংস্কারের জন্য কমিশন আছে। তারা পরামর্শ দেবে আমরা কাজ করব। আমরা চাই, স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। খুব কম জিনিস উচ্চ পর্যায়ে থাকবে। দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেম, একবার একটা ফান্ড বানিয়ে দিলে কারা যেন খেয়ে ফেলে। সেজন্য সুশৃঙ্খলভাবে সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। যেন স্থায়ী হয়।'

দেশের অর্থনীতি ও আদর্শিক রাজনীতির দিকে নজর না দিয়ে দেশপ্রেমহীন দলতন্ত্র ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াটাই অনেকের একমাত্র কাম্য। ফলে জনপ্রত্যাশা অপূরণীয়ই থেকে যায়। সংস্কারমূলক কর্মসূচি কে বাস্তবায়ন করিবেন-প্রশ্নোত্তরে এক পত্রিকা ৪ ডিসেম্বর ২০২৪ সম্পাদকীয়তে তাবৎ বিশ্লেষণ শেষে লেখেন, 'যেই দেশের রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতা ও ম্যাচুরিটি প্রশ্নবিদ্ধ, সেই দেশে এমন আশঙ্কা দেখা দেওয়াটা অমূলক নহে। তাই কীভাবে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যায়, আজ যারা সরকারে আছেন, সেই চিন্তাভাবনাও তাদের থাকা প্রয়োজন।'

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দলসমূহ যে সংস্কারকাজগুলো নিয়ে ঐকমত্যে আছে, তাকে দৃঢ়চিত্তে দেশপ্রেম নিয়ে তাড়াহুড়া না করে এগিয়ে যেতে হবে। সর্বোপরি যেহেতু অর্থনৈতিক মুক্তিতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, সেহেতু যৌক্তিক কারণেই পরিবর্তনের জন্য সংস্কার কর্মসূচিকে আগে সমাপ্ত করতে হবে। ছাত্র-জনতাসহ 'ন্যাশন বিল্ডার' ড. ইউনুসকে সে পথেই থাকতে হবে। তাহলেই দেশ অবশ্যই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথে একতালে একসঙ্গে এগিয়ে যাবে- বৈষম্যহীন দেশ সৃষ্টি হবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থায়ী হবে। আলাহ সহায় হোন। 

লেখক: ডরপ 'এর প্রতিষ্ঠাতা ও গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী।

বি:দ্র: লেখা আমার উন্নয়ন ও মানবাধিকার পথচলার গুরুজন। তার এই আর্টিকেলটি আজ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মুঠোফোনে তিনি আমাকে লেখাটি প্রকাশের জন্য বলেন। তার অনুরোধ নড়াইলকণ্ঠ পাঠকদের জন্য লেখাটি প্রকাশ করা হলো। সম্পাদক, নড়াইলকণ্ঠ.কম