• 03 May, 2024

নড়াইলে হাজারো কণ্ঠে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ উচ্চারিত

নড়াইলে হাজারো কণ্ঠে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ উচ্চারিত

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর রেসকোর্স ময়দানে ‘ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর স্বীকৃতি পায়। স্বীকৃতি পাওয়ার পরের বছর (২০১৮ সাল) থেকে এই ব্যতিক্রমী আয়োজন নড়াইলে শুরু হয়। আজ এই ব্যতিক্রমি আয়োজনের ৭ বছর পূর্ণ হলো। এই আয়োজনের উদ্যোক্তা নড়াইলের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।

স্টাফ রিপোর্টার : প্রতি বছরের ন্যায় এবারও নড়াইলে হাজারো কণ্ঠে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ ও শুদ্ধস্বরে জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হযেছে।  

nrailknth-marc-004.jpgবৃহস্পতিবার (০৭ মার্চ) সকাল ১০টায় নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ মাঠে সুলতান মঞ্চ চত্বরে জেলা প্রশাসন ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে হাজারো কণ্ঠে ৭ই মার্চের ভাষণ উচ্চারিত হয় এবং এর পর পরই হাজারো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।

সুলতান মঞ্চ চত্বরে এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে ‘৩০ ফুট লম্বা বঙ্গবন্ধু টাওয়ার প্রদর্শন, ‘২৭০ ফুট লম্বা ও ৮৫ ফুট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট সহ¯্র্র মানুষের সমন্বয় গঠিত বাংলাদেশের মানচিত্র এবং ৬০ বাই ৩৬ ফুট বিশিষ্ট জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করা হয়।

nrailknth-marc-002.jpgএ সময় সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি স্থানীয় সরকার বিভাগ (ডিডিএলজি) এর উপ-পরিচালক জুলিয়া সুকাইনা, জেলা পুলিশ সুপার মেহেদী হাসান, নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: শাহাবুদ্দিন, পৌর মেয়র আঞ্জুমান আরা, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো: নিজাম উদ্দিন খান নিলু, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুর রহমান হিলু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মলয় কুন্ডু, সাধারণ সম্পাদক শরফুল আলম লিটু প্রমুখ।

এ সময় জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

nrailknth-marc-003.jpgউল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানের ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে নড়াইলে প্রতিবছর ব্যতিক্রমী আয়োজনের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের (১৯ মিনিট) ঐতিহাসিক ভাষণ:   
ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বোঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশের ইতিহাসকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস- এই রক্তের ইতিহাস মুমূর্ষু মানুষের করুণ আর্তনাদ- এদেশের করুণ ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।

১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খাঁ মার্শাল-ল’ জারিকরে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৪ সালে ৬-দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আয়ুব খাঁর পতনের পরে ইয়াহিয়া এলেন। ইয়াহিয়া খান সাহেব বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন- আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করেছিলাম ১৫ই ফেব্র“য়ারি তারিখে আমাদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দিতে। তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসে প্রথম সপ্তাহে সভা হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেমব্লিতে বসবো। আমি বললাম, এমেব্লির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায় কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনের মতেও যদি তা ন্যায্য করা হয়, আমরা মেনে নেব।

ভুট্টো সাহেব এখানে ঢাকায় এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরো আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করলাম- আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো- সবাই আসুন বসুন। আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বর যদি আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেমব্লি। তিনি বললেন, যে যে যাবে তাদের মেরে ফেলা দেওয়া হবে, যদি কেউ এসেমব্লিতে আসে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেমব্লি চলবে। আর হঠাৎ ১ তারিখ এসেমব্লি বন্ধ করে দেওয়া হলো।

ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেমব্লি ডেকেছিলেন। আমি বললাম, আমি যাবো। ভুট্টো বললেন, যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে এলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষের, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম, আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দিন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো, সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। আমি বললাম, আমরা জামা কেনার পয়সা দিয়ে অস্ত্র পেয়েছি বহিঃশত্র“র আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করবার জন্য, আজ সেই অস্ত্র আমার দেশের গরীব-দুঃখী মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের উপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কিভাবে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, আপনি দেখুন। তিনি বললেন, আমি ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকবো।

আমি বলেছি কিসের এসেম্বলি বসবে, কার সঙ্গে কথা বলবো? আপনার আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলবো? পাঁচ ঘণ্টার গোপন বৈঠকে সমস্ত দোষ তারা আমাদের উপর, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন। দায়ী আমরা।

২৫ তারিখ এসেম্বলি ডেকেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। ১০ তারিখে বলেছি, রক্তে পাড়া দিয়ে, শহীদের উপর পাড়া দিয়ে এসেম্বলি খোলা চলবে না। সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকের ভিতর ঢুকতে হবে। যে ভাইদের হত্যা করা হয়েছে তাদের তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে আমরা বসতে পারি না।

আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার করে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলি আছে সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুরগাড়ি, রেল চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জর্জকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তর, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, এরপর যদি ১টি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় - তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবে। সৈন্যরা, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।

আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আওয়ামী লীগ অফিসে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর ৭ দিন হরতালে শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেক শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততদিন ওয়াপদা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। শুনুন, মনে রাখুন, শত্র“ পিছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান যারা আছে আমাদের ভাই, বাঙালী, অ-বাঙালী তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, কর্মচারীরা, রেডিও যদি আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, তাহলে টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনে পত্র নিতে পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাফ আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বাংলাদেশের নিউজ বাইরে পাঠানো চলবে।

এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে- বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে , প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন। এবং আমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি আরো রক্ত দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইন্শাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।