শুক্রবার (৩১ মে) সকাল ১০টায় নড়াইল পৌরসভার উদ্যোগে পৌর ভবনের সামনে থেকে তামাক বিরোধী বিভিন্ন শ্লোগানে একটি বর্ণাঢ্য র্যালী বের করা হয়। র্যালীটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে একই স্থানে এসে শেষ হয়।
নড়াইল পৌরসভার মেয়র আঞ্জুমান আরার নেতৃত্বে বর্ণাঢ্য র্যালীটিতে উপস্থিত ছিলেন পৌরসভার কাউন্সিলর মোহাম্মদ রেজাউল বিশ্বাস, পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওয়াহাবুল আলম, পৌর সানফ্লায়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহ-সভাপতি সালেহা পারভিন, দৈনিক ওশানের সম্পাদক ও নড়াইল প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আলমগীর সিদ্দিকী, স্বাবলম্বী সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের সদস্য কাজী হাফিজুর রহমান, সাংবাদিক মুন্সি আসাদুর রহমান, সুজয় বকসী, হাফিজুল করিম নিলু, নড়াইলকণ্ঠের প্রতিনিধি সোহাগ রায়, নড়াইল পৌরসভার কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ, পৌর সানফ্লায়ার স্কুলের শিক্ষক বৃন্দসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
র্যালী শেষে পৌর মেয়র আঞ্জুমানারা সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন, আজ থেকে নড়াইল পৌরসভার অফিসসহ পৌর ক্যাম্পাস ধুমপান মুক্ত ঘোষণা করা হলো এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত সময়ের মধ্যে সমগ্র নড়াইল পৌর এলাকা তামাকমুক্ত করা হবে।
এ সময় মেয়র আরও জানান, নড়াইল পৌরসভার সেবা নিতে আসতে হলে নিজেকে তামাকমুক্ত করে আসতে হবে। তা না হলে কোন সেবা দেওয়া হবে না।
উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য ২০২৩ অনুযায়ী, তামাক ব্যবহারের ফলে বিশ্বে প্রতি বছর ৮ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারা যায়। তামাক এবং ধূমপান, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ব্যাধিসহ মুখ, গলা, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, মূত্রাশয়, কিডনি, লিভার এবং পাকস্থলীর মতো একাধিক অঙ্গকে প্রভাবিত করে এবং ২০টিরও বেশি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার রোগ ঘটায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাকের মধ্যে থাকা নিকোটিন এর অত্যন্ত আসক্তি এবং ফলে তামাকের ব্যবহার কার্ডিওভাসকুলার ও শ্বাসযন্ত্রের রোগসহ অন্যান্য রোগ দুর্বল স্বাস্থ্য ও মৃত্যুর প্রধান ঝুঁকির কারণ। তামাক অধূমপায়ীদের জন্যও মারাত্মক হতে পারে। সেকেন্ড-হ্যান্ড ধূমপান স্বাস্থ্যের প্রতিকূল ফলাফলের সঙ্গে জড়িত। যার ফলে বছরে ১.২ মিলিয়ন মৃত্যু ঘটে। প্রায় অর্ধেক শিশু তামাকের ধোয়া দ্বারা দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয় এবং ৬৫ হাজার শিশু গর্ভবতী থাকাকালীন ধূমপানের কারণে প্রতি বছর মারা যায়। গর্ভবতী থাকাকালীন ধূমপানে শিশুর জীবনব্যাপী স্বাস্থ্যগত অসুস্থার কারণ হতে পারে। তাই তামাক-সম্পর্কিত অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার হ্রাস রোধে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ একান্ত অপরিহার্য।
সদস্য রাষ্ট্রগুলো এই তামাক মহামারি এবং এর ফলে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ও রোগের প্রতি বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস সৃষ্টি করে। ১৯৮৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ ডঐঅ ৪০.৩৮ রেজলিউশন পাস করে, ৭ এপ্রিল ১৯৮৮কে একটি বিশ্ব ধূমপানমুক্ত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। পরে ১৯৮৮ সালে ডঐঅ ৪২.১৯ রেজলিউশন পাস করে প্রতিবছর ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উদযাপনের আহ্বান জানায়। সেই হতে প্রতিবছর ৩১ মে দিবসটি উদযাপন হয়ে আসছে। এখানে উল্লেখ্য, ধূমপান মুক্ত দিবস সচেতনতা প্রচারাভিযান প্রাথমিকভাবে যুক্তরাজ্যে ১৯৮৪ সালে চালু করে।
প্রতি বছর, WHO দিনটির জন্য একটি থিম বা প্রতিপাদ্য বিষয় নির্বাচন করে যাতে তামাকমুক্ত দিবস (WNTD )-এর জন্য আরও একীভূত বিশ্ব বার্তা তৈরি করা যায়। এই থিমটি পরবর্তী বছরের জন্য WHO -এর তামাক-সম্পর্কিত এজেন্ডার কেন্দ্রীয় উপাদান হয়ে ওঠে। WHO ব্রোশিয়র, ফ্লাইয়ার, পোস্টার, ওয়েবসাইট এবং প্রেস রিলিজসহ থিমের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রচার সামগ্রী তৈরি এবং বিতরণের তদারকি করে। এর অনুসরণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলোতেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রচারসামগ্রী তৈরিসহ নানা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে দিবসটি উদযাপন করে থাকে। এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২৪-এর প্রতিপাদ্য হলো Pr o tecting children from tobacco industry interference ; যা বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ভাবানুবাদ হলো ‘তামাক কোম্পানির আগ্রাসন প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি।’ বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারে অবদান রাখার প্রধানতম কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘তামাক কোম্পানির অবৈধ হস্তক্ষেপ’ ও সেই সঙ্গে তামাকপণ্যের প্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতা এবং তরুণদের তামাক ব্যবহারে প্রলুব্ধ করা। তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বলতে সংক্ষেপে বুঝায়, তামাক কোম্পানি তার অর্থনৈতিক শক্তি, লবিং, বিপণন যন্ত্রপাতি, মিডিয়া ম্যানিপুলেশন ও করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালনের (ঈঝজ) নামে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে কোম্পানির পণ্যের বিক্রয়, বিতরণ ও প্রচার। ধূমপানে আকৃষ্ট ও আসক্তি সৃস্টি করতে নতুন এবং তরুণ ধূমপায়ীদের নিয়োগদান, বিভিন্ন কনসার্টে স্পন্সর করা, লোভনীয় ও আকর্ষণীয় গিফট প্রদান ইত্যাদি করা হয়ে থাকে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করণে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও তার যথার্থ প্রয়োগে বিলম্বিত করার জন্য সরকারকে হেরফের করা এবং স্বাস্থ্য পেশাদারদের পৃষ্ঠপোষকতাসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন এবং প্রয়োগ এর সবই তামাক কোম্পানির অবৈধ হস্তক্ষেপের মধ্যে পড়ে।
ATS ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩৭.৮ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিয়মিত তামাক সেবন করে। তাদের মধ্যে ১৯.২ মিলিয়ন ধূমপায়ী। অপরদিকে প্রায় ২২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ধোঁয়াবিহীন তামাক (ঝসড়শব-খবংংঞড়নধপপড়) ব্যবহার করে, যা মুখের ক্যান্সারের জন্য উচ্চ মাত্রায় অবদান রাখে। ধোঁয়াবিহীন তামাক জর্দা, গুল, খাইনি এবং সাদাপাতাসহ বিভিন্ন আকারে পাওয়া যায় এবং তাদের কম দাম এটিকে সবার কাছে সাশ্রয়ী করে তুলেছে। ক্রয় ও ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার জন্য কম দাম তামাকজাত পণ্য সবার কাছে সাশ্রয়ী করে তোলা রোধ করতে তামাকের ওপর অধিকতর (CSR ) আরোপ একটি কার্যকর কৌশল বলে স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশে কর কাঠামো বেশ জটিল এবং ভিত্তিমূল্য এখনও খুবই কম। এর পেছনেও যে তামাক কোম্পানির অদৃশ্য হস্তক্ষেপ রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তামাক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গ্লোবাল টোব্যাকো ইনডেক্স ২০২০ অনুসারে দেশটি ৫৭টি দেশের মধ্যে ২৭তম স্থানে রয়েছে এবং ‘শিল্প হস্তক্ষেপ’ সূচক ৬৮, যা উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চস্তরে। একটি সর্বসম্মত ঐকমত্য রয়েছে যে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সীমিত বা বন্ধ করতে একটি কার্যকর তামাক কর কাঠামোর উপস্থিতি তামাক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও, যেখানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় (MOHFW) তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় দৃঢ? প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে, সেখানে অন্যান্য সরকারি সংস্থা রয়েছে; যা তামাক কোম্পানিগুলো তামাকের প্রকোপ রোধে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোকে বাধা দেয়ার জন্য ব্যবহার করেছে। এছাড়া কোম্পানির সরকারি শেয়ারও বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি বড় বাধা।