• 04 May, 2024

শহীদদের চেতনায় দেশ গড়ার শপথ

শহীদদের চেতনায় দেশ গড়ার শপথ

বাঙালি জাতিকে জ্ঞানবিজ্ঞানে, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার লক্ষ্যে বিজয়ের ঊষালগ্নে পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসররা হত্যা করেছিল দেশের হাজারও সূর্যসন্তানকে। তাদের সেই নির্মম ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করে দু’দিন পরই মাথা উঁচু করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছিল বাঙালি জাতি। সেদিনের সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আবারও কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করল পুরো দেশ।


কুয়াশা ভেদ করে যখন পূব আকাশে আলোর রশ্মি ভেসে উঠছিল, তখনই হাজার হাজার মানুষের ঢল নামতে শুরু করে রাজধানীর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে। ফুলে  ফুলে  শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে পুরো সমাধিসৌধ। 

শ্রদ্ধা জানানোর মাঝে এটাই বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, ‘... বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা, তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না।’

গতকাল বৃহস্পতিবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সব মানুষ আবারও ধিক্কার জানিয়েছে সেই পাকিস্তানকে ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলশামস, আলবদরদের। যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল জাতির মেধাবী সন্তানদের। সেই সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতেই ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের মতো দেশের পথেপ্রান্তরে বীর সন্তানদের স্মরণে গড়ে ওঠা স্মৃতির মিনার। শ্রদ্ধা জানাতে আসা বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের কথায় এটাই বারবার উচ্চারিত হয়েছে, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ এখনও পুরোপুরি চালিত হতে পারেনি। শহীদদের চেতনায় দেশ গড়ার শপথ নিয়েছে জাতি। 

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে গতকাল দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার পাশাপাশি শোকের প্রতীক কালো পতাকাও উত্তোলন করা হয়। রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, স্বেচ্ছায় রক্তদান, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা প্রভৃতি কর্মসূচি পালন করা হয়। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করে বিশেষ ক্রোড়পত্র ও নিবন্ধ।

দিনটি উপলক্ষে সকাল ৭টা ৫ মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতিকে স্মৃতিসৌধে স্বাগত জানান। পরে প্রধানমন্ত্রী শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর একটি চৌকস দল এই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করে। এ সময় বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর।

দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এর পর জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর পক্ষে জাতীয় পার্টির একটি প্রতিনিধি দল বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর পর্যায়ক্রমে স্মৃতিসৌধ সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, অঙ্গ সংগঠন ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের ঢল নামে। 

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এর পর প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে স্বাধীনতার মহান স্থপতির প্রতি সম্মান জানান।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খানের নেতৃত্বে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এখনও দেশে ডালপালা মেলে আছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে আমাদের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। 
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেও জাতিকে পঙ্গু করা যায়নি। ৫২ বছরের বেশি সময়ের পথচলায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বহুদূর এগিয়ে গেছে।

বিএনপি নেতা ড. মঈন খান বলেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে দেশের অমূল্য সম্পদ বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, যেটা ছিল নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম কাজ। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও গণতন্ত্র কায়েম করতে পারিনি। আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলন করে যাচ্ছি, পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।
শীত-কুয়াশা উপেক্ষা করে বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ, দল-মত, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্মৃতিসৌধগুলোতে ঢল নামে। তারা ফুল দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানান। সারাদিনই স্মৃতিসৌধগুলোতে ছিল শ্রদ্ধা নিবেদনের ভিড়। 

জাতীয় পতাকা, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি সংবলিত পোস্টার, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনার ছবি, পত্রিকার কাটিং, ব্যানার আর ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ চত্বর। দক্ষিণ প্রান্তে সবুজ চত্বরে কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি, ফুল ও পতাকা দিয়ে তৈরি করে একটি স্থাপনা। ইটের স্তূপের ওপর ছোট শিশুরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহের অনুকরণে শুয়ে থেকে সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যপট তৈরি করে। শ্রদ্ধা নিবেদনের সঙ্গে চলে আবৃত্তি ও সংগীত পরিবেশনা।

বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে রাজধানীর ধানমন্ডিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর কার্যালয়ে আয়োজিত ‘রক্তঋণ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মশিউর রহমান বলেন, আমরা শহীদদের স্মরণ করি– এ কারণে আমরা এর মধ্যে সত্য অনুসন্ধান করি। নিজেদের শানিত করি।

স্মৃতিচারণ করে শহীদ মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর বলেন, পাঠ্যসূচিতে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে পাঠ থাকা আবশ্যক। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা যাতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্পর্কে জানতে পারে। আমরা এ বিষয়ে শুধু ১৪ ডিসেম্বর কথা বলতে চাই না। সারা বছর আমরা কথা বলতে চাই। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, দেশে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এখনও সক্রিয় রয়েছে। পেছনের রাস্তা দিয়ে অগণতান্ত্রিক পন্থায় তারা ক্ষমতায় আসতে চায়। এদের প্রতিহত করে দেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
দিনটি উপলক্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এটা  বুঝতে পেরে দেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে শুরু করে। কিন্তু লজ্জাজনক ব্যাপার হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসেও পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি।