একই সঙ্গে রিটার্নে অপ্রদর্শিত অফশোর সম্পদ বা বিদেশে স্থাবর সম্পদ দেখানোর সুযোগ বাতিল করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলতি বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে ১৯এফ নামে একটি ধারা যুক্ত করে ‘ট্যাক্স অ্যামনেস্টি’ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত যে কেউ জরিমানা ছাড়া শুধু ৭ শতাংশ হারে আয়কর দিয়ে বিদেশ থেকে যেকোনো পরিমাণ অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনতে পারবেন। এক্ষেত্রে সম্পদের উৎস নিয়ে সরকারের অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন করতে পারবে না। করদাতার ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যাংক মোট অর্থের ৭ শতাংশ কর কর্তন করে চালানের সরকারি কোষাগারে জমা দেবে এবং করদাতাকে একটি প্রত্যয়নপত্র দেবে। সেই প্রত্যয়নপত্র করদাতাকে রিটার্নের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিদেশে পাচারকৃত টাকা ফেরাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান। একই সঙ্গে এ সুযোগে টাকা ফেরত আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এত কষ্ট করে যারা বিদেশে টাকা নিয়ে গেছে, তারা নিশ্চয় ফেরত আনার জন্য নেয়নি। বাজেটে দেওয়া কর ছাড়ে টাকা ফেরত আসবে- সেটা প্রত্যাশা করা বোকামি। তা ছাড়া পাচার করা টাকাই রেমিট্যান্স হিসেবে আনলে সরকারই আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে, আবার টাকাও বৈধ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে ৭ শতাংশ কর দিয়ে কেন মানুষ টাকা বৈধ করবে। আগামী বাজেটে এ সুবিধা রাখা উচিত নয়।
বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থ পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এ ছাড়া অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
অন্যদিকে সুইস ব্যাংকের তথ্য মতে, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) ২০২১ সালে বাংলাদেশিদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্র্যাংক, স্থানীয় মুদ্রায় যা ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ৯৫ টাকা হিসাবে)। এই টাকা অন্তত ২১টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান। আগের বছরের চেয়ে এই আমানত প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২০ সালে যা ছিল ৫ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
এ ছাড়া বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তি বছরে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় করলে তাকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনো ব্যক্তির ৫০ লাখ টাকা বার্ষিক আয় থাকলে তাকে ১০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। এ নিয়মে কর না দিলে তার অর্জিত অর্থ অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই সমপরিমাণ অর্থ বিদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে এনে সাড়ে তিন লাখ টাকা আয়কর দিয়ে সেটা বৈধ করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এ নীতি অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক। এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হয়েছেন। বাজেট ঘোষণার পরপরই সব মহল থেকে সেটা বলা হয়েছে। গত ৯ মাসে এ সুযোগ কেউ নেয়নি, এটা সাধারণ ঘটনা। তার চেয়ে বড় উদ্বেগের কথা হলো, এ সুযোগ নিতে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে গেল কি না- সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। গত কয়েক মাসে অপ্রাতিষ্ঠানিক মার্কেটে ডলারের দাম ও ব্যাংকে ডলারের দামের পার্থক্য দেখলে বিষয়টা কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, একজন ব্যক্তিকে বাংলাদেশে আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হচ্ছে। ওই একই পরিমাণ অর্থ বিদেশ থেকে ঘুরিয়ে আনলে ৭ শতাংশ কর দিতে হবে। এত বড় কর ব্যবধানের সুযোগ নিতে চাইতে পারে যেকোনো ব্যক্তি। তাই এ নীতি টাকা পাচারকে উৎসাহিত করছে কি না- সেটা আগামী বাজেটে ভেবে দেখা উচিত।