গ্রামে অভাব তেমন ছিল না, তবে ধনী-গরীবের ব্যবধান যে ছিল না তাও নয়। যারা গরীব মানুষ তারা অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে ধনী লোকের বাড়িতে মাসিক বেতনে কাজ করতেন।
গ্রামের দুই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মধইলে ছিল পোস্ট অফিস। উত্তর দিকে কয়েকটি পাড়া নিয়ে পানিওড়া ও গয়ারপুর গ্রাম। পূর্বে কুতুরা বিলের পাড়ে বেশ কয়েকটি বিশাল বিশাল আদিবাসী পাড়া। আমাদের এবং সুবরাজপুর গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই অবস্থাসম্পন্ন। বাকি গ্রামগুলোর বেশির ভাগেই খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষজনের বসবাস। এদের মধ্যে অনেকেই (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) আমাদের এবং সুবরাজপুর গ্রামের বড় বড় গৃহস্থ বাড়িতে মাসিক বেতনের কর্মচারি ছিল, কাজেই কৃষিকাজের জন্য শ্রমিকের অভাব ছিল না।
৫০/৬০ বছরের ব্যবধানে আগের সেই চিত্র এখন আমূল পাল্টে গেছে। অর্থাৎ একসময় অভাবের তাড়নায় যারা অন্য গ্রাম থেকে আমাদের আমাইপুকুর এবং সুবরাজপুর গ্রামে কাজের সন্ধানে আসতো বা অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে বেতনভূক্ত কর্মচারি ছিল, তাদের কেউ কেউ আজ বেশ জমি-জিরাত বা ক্ষেত-খামারের মালিক। কেউবা আবার ব্যবসায়ী অথবা চাকরিজীবী। তাদের অনেকেরই এখন ইট-সিমেন্টে তৈরি ইমারত বা পাকা টিনসেড বাড়ি। সব বাড়িতেই সেনেটারি ল্যাট্রিন আছে। এদের কেউ কেউ এখন মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে চলাফেরা করে। জীবনযাত্রায় অনেকটা রাজসিক ভাসার।
বাবা রেশনের ডিলারশিপ আর সাংসারিক কাজকর্ম এবং জামাইদের দাওয়াত করে বাড়িতে আনা নেয়াসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে লাগলেন। বেশিরভাগ সময় রাতের দিকে প্রচণ্ড পেটের ব্যথায় ঘুমাতে পারতেন না। বাড়িতে বাবার জন্য পথ্য হিসেবে প্রতিদিনই জিয়ল মাছ বা বাচ্চামুরগির মাংস রান্না হতো। একদিন দুপুরে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার প্রচণ্ড বমি শুরু হলো। পেটে দানাপানি অবশিষ্ট থাকলো না। দাদা-দাদি এবং দুই মা সবাই বাবাকে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। রাতের দিকে শুরু হলো জ্বর, সঙ্গে প্রচণ্ড কাশি। এরপর থেকে বাবা আর ভাত খেতে পারতেন না । ভাত খেলেই বমি করতেন।
এ অবস্থা এক রকম নিয়মে পরিণত হলো। ফলে স্থানীয় ডাক্তার ও আমার দাদা মিলে সিদ্ধান্ত দিলেন সিরাজের আর ভাত খাওয়া চলবে না- খৈ, দুধ খেতে হবে। আমাদের তিনটা গাভী থাকায় দুধের অভাব ছিল না।
এভাবে আরো দু'তিন মাস পার হলো। ধীরে ধীরে বাবার শরীর খারাপ হতে শুরু করে। শরিকের বাপ-চাচাদের পরামর্শে বাবা চিকিৎসার জন্য আবার কলকাতা চলে গেলেন। সঙ্গে তো ছফে আছেই। ডা. বিধান রায়ের পরামর্শ নিয়ে বাবা নিজ হাতে দাদার কাছে চিঠি লিখলেন, মাদ্রাজের কয়েকজন বিখ্যাত ডাক্তারকে দেখাবেন বলে। চিঠির উত্তরে দাদা বাবাকে মাদ্রাজ যাওয়ার অনুমতি দিলেন। বাবা কলকাতা থেকে ট্রেনে মাদ্রাজ চলে গেলেন এবং সেই ডাক্তারদের চিকিৎসা নিতে শুরু করলেন।
মাদ্রাজে প্রায় দু'মাসেরও বেশি সময় ধরে কয়েকজন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিলেন বাবা। এ সময় দাদার কাছে তিনি দীর্ঘ একটা চিঠি লিখেন। চিঠিতে বাবা লিখলেন, 'আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না। তাই এখানে আর থাকতে চাই না। বাকি যে কয়দিন বাঁচি- টুকুবাবুকে (আমাকে) কোলেপিঠে নিয়ে আদর করে মরে যেতে চাই।'
চিঠিটা দাদা নিজেই পড়লেন, অশ্রুসজল হয়ে উঠলো তাঁর চোখ, কান্নাভেজা কণ্ঠেই পড়া শেষ করলেন। বাবার এই মর্মস্পর্শী চিঠির উত্তরে বাবাকে দ্রুত বাড়ি আসার পরামর্শ দিলেন। সে সময় মধইল পোস্ট অফিস থেকে চিঠি পোস্ট করলে মাদ্রাজে পৌঁছতে সময় লাগতো ১৫/২০ দিন।
দাদার চিঠির অপেক্ষায় ছিলেন বাবা। বঙ্গোপসাগরের করমণ্ডল উপকূলে অবস্থিত মাদ্রাজ নগরীর নাম পরে পরিবর্তন করে চেন্নাই রাখা হয়। বর্তমানে চেন্নাই ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী। মাদ্রাজের আবহাওয়া খুব স্বাস্থ্যকর, কলকাতার বহু বনেদি পরিবারের লোকজন তখন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য মাদ্রাজ বেড়াতে যেতেন। বাবা প্রতিদিন মাদ্রাজের সমুদ্র সৈকতে হেঁটে বেড়াতেন।
কঠিন মনোবল এবং ওষুধের জোরে বাবা আরো কয়েকদিন মাদ্রাজে থাকার জন্য মনস্থির করলেন। কিন্তু তামিল বা তেলেগু ভাষা না জানার কারণে মাদ্রাজে প্রায়শই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তারপরও তিনি এক নাগাড়ে প্রায় তিন মাস মাদ্রাজে অবস্থান করেন। পরে ট্রেনযোগে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় এসে আবারো ডা. বিধান রায়কে দেখালেন। এবারও ডাক্তার রায় বাবাকে বললেন- ‘তোমার অপারেশন ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা নেই।' যে পরামর্শ তিনি বাবাকে আগেই দিয়েছিলেন।
ডা. রায় বাবাকে পূর্বেই বলেছিলেন, যদি আলসার অপারেশন করাতে দেরী করো, তাহলে তা ক্যান্সারে রূপ নেবে। তখন আর কিছু করার থাকবে না।
শরীরের বিষয়ে ডাক্তারের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে- মৃত্যু যে অতি নিকটে, তা বুঝতে বাবার আর বাকি থাকলো না। কলকাতায় কয়েকদিন থেকে আমার এবং অন্যদের জন্য শার্ট, পাজামা, চাদর, শাড়ি এবং অন্যান্য বাজার-ঘাট করে বাসার মালিক আব্দুল মান্নান সাহেবের নিকট চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে আমাইপুকুর চলে আসলেন। বাড়ি এসে দেখেন, সাংসারিক ঝামেলা এবং ছেলের চিন্তায় দাদার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। দাদা ও বাবা দু'জনে দু'জনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিলাপের সুরে কান্নাকাটি করলেন। তখন আমার বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর। হাঁটতে ও দৌড়াতে পারি। বাবা চিকিৎসার জন্য বাইরে থাকায় ছোটবেলা থেকে দাদার কোলে-পিঠে মানুষ হয়েছি। মা আর দাদা-দাদিকেই আমার অতি আপনজন মনে করি। তাদের আদর- সোহাগে আহলাদিত হই।
বাবা বাড়ি ফিরে আবারো ব্যবসার কাজে মনোনিবেশ করলেন। জমি-জমার কাগজপত্র আর সংসারের ঝুটঝামেলা দাদার কাঁধে দিয়ে নিজে ঝামেলামুক্ত থাকার চেষ্টা করলেন। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও বাবা শারীরিকভাবে বেশ শক্তিশালী ছিলেন। কাজের লোকদের প্রতি কড়া নজর রাখতেন। এইভাবে আরো ছয়মাস কেটে গেল। আমার বয়স তখন চার বছর ছুঁইছুঁই। বাবা প্রতিদিন খুব ভোরে উঠতেন। নামাজ শেষে গরু-মহিষের খাবার দেওয়া এবং কাজের লোকদের বিভিন্ন কাজের তদারকি করতেন।
বাবার মৃত্যু :
দিনটা ছিল শুক্রবার। বাবা উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন এবং মাকে বললেন, দাদাকে ডাকতে। দাদা এসেই বাবার নাম ধরে ডাকলেন। বাবা কিছুতেই কথা বলতে পারছেন না। বিছানায় শোয়া অবস্থায় বমি করে ফেললেন। বমির রং ছিল লাল। দাদা যেহেতু ডাক্তার ছিলেন তাঁর বুঝতে আর দেরি হলো না যে, সিরাজের চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে। বাবা অতি কষ্টে দাদাকে শুধু বললেন 'বাবা আর বাঁচবো না, তোমরা এবং শরিকের কোনো মানুষ আগামী দু-একদিন যেন কোথাও না যায়। আর আমার টুকুবাবুসহ মেয়েদের দেখে মানুষ করো। খুব শীঘ্রই আমি ইহজগৎ ছেড়ে চলে যাবো।' বাবার কথা শেষ হতে না হতেই শুরু হলো অনবরত বমি। কয়েকবার বমির পর বাবা শারীরিক দিক থেকে কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন এবং উঠে বসলেন। সবার সঙ্গে ভালো মতো কথা বলতে পারলেন না। তাঁর কথা মতো মৃত্যুর আর মাত্র দু-একদিন বাকি। ইতোমধ্যে বাবার কঠিন অসুখের কথা শুনে সমস্ত আত্মীয়-স্বজন আমাদের বাড়িতে আসলেন। অসুস্থ একজন ব্যক্তি তার মৃত্যুর সময় নিজেই ঠিক করে বলতে পারে। এমন অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য শত শত মানুষজন আমাদের বাড়িতে ভিড় জমাতে থাকেন ।
আমাদের গ্রামে আমরা বড় পরিবার, আত্মীয়-স্বজন অনেক। তাছাড়া গ্রামের এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকেরা তো আছেই। বাবার তিন মেয়ে জামাই সার্বক্ষণিক বিছানার চারপাশে সারিবদ্ধ হয়ে বসে আছেন এবং বাবা তাদের সঙ্গে দু'একটা কথাও বলছেন। এমনকি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও শোয়া অবস্থায় দাদাকে জড়িয়ে ধরে পরামর্শমূলক কথাবার্তা বলেছেন। বাবা দাদাকে বলেছেন, ‘তুমি ডিলারশিপ চালাতে পারবে না। তোমার পক্ষে কৃষিকাজও করা সম্ভব নয়। জমি-জমা সব বর্গা দিয়ে তুমি রাজার হালে দিন কাটাতে পারবে।' এটাই ছিল গুরুতর অসুস্থ বাবার শেষ কথা ।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৪। সোমবার সকাল এগারোটা, বাড়ি-ঘর ভর্তি মানুষ। আমার বয়স তখন চার বছর দুই মাস। বাবার মৃত্যুর সময় আমি দাদার কোলে ছিলাম। আমাকে নিয়েই দাদা মুর্ছা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক আমার ওই মুহূর্তের কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর তাকে শেষ গোসল দেয়ার দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে। গোসলের সময় উঠোনে চৌকি পেতে বাবার লাশ রাখা, চৌকির উপর মশারি খাটানো ইত্যাদি দৃশ্য আমি এখনো চোখ বুজলে দেখতে পাই । বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি ছাড়াও আদিবাসীপল্লী থেকে বহু আদিবাসীও এসেছিল। অনেক লোকের ভিড়ে এক আদিবাসী বংশীবাদকও ছিলেন। আমার শিশুমন ওই বাশিওয়ালার কাছে আমাকে টেনে নিয়ে যায়। আমি কান্না জুড়ে দিলাম বাশিটা নেয়ার জন্য ।
বাবার মৃত্যুর এক মাস আগে একটা মুহূর্তের কথা আমার খুব মনে পড়ে। বাবা জামা-কাপড় পরে হাতে একটা খাকি রংয়ের চটের ব্যাগ নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, আমি তখন তাঁর পিছু নিই, বাবা কিছুতেই আমাকে ছাড়াতে পারছিলেন না। পরে আমাকে কালু দাদা (দাদার ছোট ভাই) ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। দৃশ্যটা এখনো আমার স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল ।
অল্পদিনের মধ্যেই আমার শিশুমন থেকে বাবার স্মৃতি ম্লান হয়ে গেল ৷ বাবা মারা গেলেন, না কোথায় গেলেন- সে কথা ভুলে গেলাম। শুধু মায়ের কোলে বসে জিজ্ঞেস করতাম, বাবা কোথায় গেছে বা কখন আসবে?
মাকে এ সব প্রশ্ন করতাম বারবার। মা বলতেন- 'আগামী শুক্রবার আসবে।' শুক্রবার শেষ হলে আবার জিজ্ঞেস করতাম। একসময় বাবার কথা সব ভুলে গেলাম। দাদা হয়ে উঠলেন আমার সব। তাঁর অপত্যস্নেহ এবং অভিভাবকত্বে আমার জীবনে নতুন দিগন্তের সূচনা হলো ।
বর্ণিত সব ঘটনার কথা আমি বড় হয়ে মা, রহিমা ফুফু এবং বড় বোন সুফিয়া বুবুর নিকট শুনেছি। তবে শৈশবের অনেক স্মৃতিই আমার মানসপটে এখনো গেঁথে আছে। আমার বয়স যখন প্রায় সাড়ে চার বছর তখন থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত কথা, রটনা বা ঘটনা সবকিছুই অনর্গল বলে যেতে পারি। তাই লিখতে শুরু করলাম আমার জীবনের “ছেঁড়াস্মৃতি”। আমার বয়স এখন ৭০ বছরের বেশি। বহুদিন থেকেই লিখবো-লিখবো বলে ভাবছিলাম। এখন আমার অখণ্ড অবসর, অফুরন্ত সময়। তাই আমি এই সময়টাই বেছে নিলাম আমার জীবনপঞ্জি লেখার।
চলমান .......................অনলাইন সংস্করণ - ০২ (১৫ থেকে ১৮ পৃষ্ঠা)