• 30 Sep, 2025

পাঁচগ্রাম ইউনিয়ন: সম্ভাবনা সংকট ও নাগরিক দাবি-এক দশকের বেশি সময় পেরিয়েও অবকাঠামো ও সেবাবঞ্চিত ইউনিয়নের মানুষ

পাঁচগ্রাম ইউনিয়ন: সম্ভাবনা সংকট ও নাগরিক দাবি-এক দশকের বেশি সময় পেরিয়েও অবকাঠামো ও সেবাবঞ্চিত ইউনিয়নের মানুষ

পাঁচগ্রাম ইউনিয়ন গঠনের আগে এ এলাকার পাঁচটি গ্রাম ছিল পেড়লী ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্থানীয় জনগণ আলাদা একটি ইউনিয়ন গঠনের দাবি জানায়। তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলেই ২০১২ সালের ৫ই মে সরকারিভাবে পাঁচগ্রাম ইউনিয়নের স্বীকৃতি মেলে।

দাবি ও প্রত্যাশা:

দ্রুত নিজস্ব ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ। 
জরুরি ভিত্তিতে ভূমি অফিস স্থাপন। 
একটি পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (FWC) স্থাপন। 
প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কমিউনিটি ক্লিনিক চালু। 
১৪ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা দ্রুত পাকা করার ব্যবস্থা। 
চিত্রা, নবগঙ্গা ও আফরা নদীর ড্রেজিং কার্যক্রম। 
স্লুইসগেট উজানের খালগুলো পুনঃসংযোগ করে পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা। 
বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণে টেকসই কর্মসূচি। 
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কার্যকর কর্মসূুিচ গ্রহণ।  
অনলাইন প্রতারণায় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ কামনা। 
বৃক্ষরোপন কর্মসূচি গ্রহণ।

নিজস্ব প্রতিবেদক: "নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার পেড়লী ইউনিয়নের- যাদবপুর, মহিষখোলা, সাতবাড়িয়া, পাটেশ^রী এবং পেড়লীস্থান এই ৫টি গ্রামের মানুষ দীর্ঘদিন একটি আলাদা ইউনিয়ন পরিষদ গঠনের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম চালায়। ওই পাঁচটি গ্রামের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ২০১২ সালের ৫ই মে “পাঁচগ্রাম” ইউনিয়ন নামে একটি ইউনিয়ন পরিষদ সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি পায়।  প্রশাসনিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০১২ সালের ১৬ই অক্টোবর নবগঠিত পাঁচগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইউনিয়নের প্রথম নির্বাচনে পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এস এম সাইফুজ্জামান। এ ইউনিয়নে দ্বিতীয় টার্মে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জহুরুল হক মোল্যা। তৃতীয় টার্মে অর্থাৎ বর্তমানে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হন এস এম সাইফুজ্জামান। "

ইউনিয়ন পরিষদ গঠনের এত বছর পরও এখানে এখনো নিজস্ব ভবন, ভূমি অফিস ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (এফডাব্লিউসি) স্থাপন হয়নি-এর কারণ কী?”

nkonline-02.jpg

এ প্রশ্নের জবাবে নড়াইলকণ্ঠ প্রতিনিধিকে পাঁচগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম সাইফুজ্জামান জানান, ২০১২ সাল থেকে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমিতে চলছে। ইতোমধ্যে ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে চরম অনটন ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনা করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন,“আমাদের নিজস্ব কোনো ভবন নেই। সঙ্গত কারণে অন্য ইউনিয়নগুলোর মতো এখানে নিয়মিত গ্রাম আদালত পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। গ্রাম আদালতে যেসব বিচার-আচার ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা, সেগুলো আমাদের ক্ষেত্রে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের থানা ও আদালতে সম্পন্ন করতে হচ্ছে। ফলে সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়ছে।”

চেয়ারম্যানের মতে, নিজস্ব ভবন না থাকায় প্রান্তিক পর্যায়ের বিচারিক ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ ন্যায্য বিচার পেতে ভোগান্তি শিকার হচ্ছেন।

"ইউনিয়নের কয়েকজন ভুক্তভোগী সাধারণ নাগরিক তারা জানান এই পাঁচ গ্রাম ইউনিয়নে ১২ বছরের মত হল আমাদের ভূমি অফিস না থাকায় অন্য ইউনিয়নে ভূমি অফিসে গেলে আমাদের নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। সময় মতো সরকারের কর-খাজনা দাখিলাসহ জমিজমা সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো রয়েছে সে বিষয়গুলো আমরা যথাযথভাবে সেবা পাচ্ছিনা। আমাদের দাবি দ্রুত এ ইউনিয়নে একটি ভূমি অফিস স্থাপন করে আমাদের এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ করে দেয় সরকার।"

"এদিকে ওই ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন কয়েকজন নারী তারা আমাদেরকে জানান, আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ নতুন হয়েছে এটা আমাদের খুবই গর্বের বা আনন্দের বিষয় ছিলো। কিন্তু দীর্ঘ বারোটি বছরের পার হয়ে গেল এখনো পর্যন্ত আমাদের ইউনিয়নে একটি এফ ডাব্লিউ সি স্থাপিত হয়নি। এই পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপিত না হওয়ার কারণে আমরা নারীরা নানা ধরনের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। চিকিৎসা নেওয়ার জন্য কালিয়া উপজেলায় গেলে প্রায় একটা দিন লেগে যায় আমাদের আসা-যাওয়া দিয়ে। তারা দাবি করে জানান-দ্রুত এই পাঁচগ্রাম ইউনিয়েনে একটি এফ ডব্লিউ সি কেন্দ্র স্থাপনের।"

“তারা আরো জানান পেড়লী ইউনিয়ন যখন ছিল তখন ওই ইউনিয়নের আওতায় বর্তমান এই পাঁচগ্রাম ইউনিয়নের দুটি কমিউনিটি ক্লিনিক বর্তমান এই ইউনিয়নে রয়েছে। যার নিয়ন্ত্রণও ওই পেড়লী ইউনিয়ন করে থাকে। আমাদের নয়টি ওয়ার্ডে সরকারের নিয়ম অনুযায়ী যে কয়টি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রয়োজন সে কয়টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপিত যাতে করে ইউনিয়নের মানুষের স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ তৈরি করে দেয় সেই দাবি রাখেন তারা।”

nkonline-03.jpg

"২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ইউনিয়নের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি ও মৎস্য। জানা গেছে, এই ইউনিয়নে এক পাশে চিত্রা নদী মাঝখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ দুই পাশে গ্রামের ঘরবাড়ী এবং রাস্তার দুই পাশে বিশাল বিল। এই বিলে একটি ফসল হয়ে থাকে। যদিও কিছু কিছু উঁচু জমিতে রবিশস্য হয়।"

"ইউনিয়নের সাপ্তাহিক হাট পাটেশ্বরীতে রোববার ও বুধবার হাট বসে থাকে। এছাড়া দৈনিক সকালে-বিকালে- সাতবাড়িয়া, পাটেশ্বরী, মহিষখোলা ও যাদবপুর এলাকায় বাজার বসে থাকে। " 

"ইউনিয়নের প্রায় ১৪ কিলো মিটারের মতো কাঁচা রাস্তা রয়েছে। এরমধ্যে পাটেশ্বরী বাজার থেকে কাটাখাল ব্রিজ পর্যন্ত ১.৪০ কিলোমিটার, মহিষখোলা পাকা রাস্তা থেকে মাসুদ মোল্লার বাড়ী অভিমুখী পর্যন্ত ০.৯০ কিলোমিটার, মহিষখোলা থিয়েদাঁড়ি থেকে কার্তিকের বাড়ী পর্যন্ত ১ কিলোমিটার, যাদবপুর বাজার হতে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত ১.৭৫ কিলোমিটার, যাদবপুর পাকা রাস্তা থেকে বিল অভিমুখী রাস্তা প্রায় এক কিলোমিটার, পাটেশ্বরী বাজার পাকা রাস্তা থেকে প্রাইমারি বিদ্যালয়ের সংলগ্ন প্রায় এক কিলোমিটার, পাটেশ্বরী মসজিদ থেকে আকরাম খাঁর বাড়ী পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার, সাতবাড়ীয়া- টাকিমারা খাল হতে চিত্রানদী পেড়লিস্থান ডাকঘর পর্যন্ত ২.৫০ কিলোমিটার, মহিষখোলা পাকা রাস্তা ব্রীজ হতে বিল অভিমুখী পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এবং পেড়লীস্থান পাকা রাস্তা হতে খেয়াঘাট পর্যন্ত ১.৪০ কিলোমিটার রাস্তা কাঁচা রয়েছে। " 

"কাঁচা রাস্তা নিয়ে স্থানীয় সাধারণ জনগণের দাবি - এ সকল রাস্তা দ্রুত বাস্তবায় না হলে মাঠ থেকে ধান সহ অন্যান্য ফসল বহনে প্রচুর ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়। স্কুল- মাদ্ররাসা ছেলে-মেয়েদের যাতায়াতের অসুবিধা হয়। যেহেতু এই ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষই কৃষি নির্ভরশীল।"

"ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট জানতে চাওয়া হয়- আপনাদের এই ইউনিয়নে অধিকাংশ এলাকাতেই তেমন কোন বয়সি গাছ-পালা দেখা যায় না কেন? তিনি আমাদেরকে জানান, এলাকার রাস্তাঘাটে এক সময় কিছু এনজিওরা গাছ লাগিয়েছিল এরপরে আর কোন তেমন উদ্যোগ নেয়নি কেউ। আর গাছ লাগানোর বিষয় অনাগ্রহ রয়েছে মানুষের মধ্যে। পারিবারিক পর্যায়ে বর্তমান কিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। আমরাও চেষ্টা করছি যাতে এলাকায় পর্যাপ্ত বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম চলমান রাখা যায়।"

বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানাযায়- এই ইউনিয়নের মহিষখোলা গ্রামের ৪০২টি পরিবারে এ বছর প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বিভিন্ন জাতের গাছের চারা রোপন করা হয়েছে। 

"চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান আরো জানান, চিত্রা নদীর ভাটির অংশের শেষ অংশটি হল এই পাঁচগ্রাম ইউনিয়ন। চিত্রা নদীর জোয়ার ভাটার যে  ¯্রােত এটা বড়জোর সিঙ্গা ব্রীজ পর্যন্ত যায়। এই পানির প্রবাহটি পুরো চিত্রানদী ব্যাপী নিয়ে যাওয়ার জন্য চিত্রা নদীর ড্রেজিংএর পাশাপাশি এই নদীর সাথে সংশ্লিষ্ট নবগঙ্গা নদী এবং আফরা নদীর ড্রেজিংও জরুরী। "

"সাবেক ইউপি মেম্বার আইয়ুব হোসেন মোল্লা জানান, পাটেশ্বরী স্লুইচগেট উজানে পাটেশ্বরী, চাচুড়ি, রমজান বিল সমূহের ভেতর যে সকল খাল নালা রয়েছে- সেগুলি নদীর সাথে সামঞ্জস্য করে পুনরায় পানি ব্যবস্থাপনা তৈরি না হলে আমাদের এই বিলে এক ফসলা থেকে বহু ফসলায় রূপান্তর করা সম্ভব নয়। এমনকি উজানের বিল সমূহের ইতিমধ্যে হাজার হাজার একর জমিতে আর কোন ফসল হচ্ছে না। পানির অব্যবস্থাপনার কারণে এই শংকট তৈরি হয়েছে প্রায় ৭/৮ বছর ধরে। "

"ইউনিয়নের বাল্যবিবাহ ও অনলাইন প্রতারণা বিষয় সম্পর্কে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, প্রতিরোধ অনলাইন প্রতারনার প্রতিরোধে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আশা করি আমরা দ্রুতই এই দুটি জায়গায় নিরাসনের পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারবো।"

"এই ইউনিয়নে ৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি কিন্ডারগার্ডেন স্কুল, একটি কওমি মাদরাসা, একটি মহিলা কওমি মাদরাসা, ১টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, এবং ২৮ টি মসজিদ রয়েছে এই পাঁচগ্রাম ইউনিয়নে ।"

"জেলার অন্যান্য ইউনিয়নের তুলনায় হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় হয় নিয়মিত। এ ইউনিয়নে হোল্ডিং ট্যাক্সের বাৎসরিক টার্গেট তিন লক্ষ টাকা এবং প্রতি বছর আদায় হয় দুই লক্ষ টাকার উপরে। "

"এই গ্রামের বিশেষ অংশ একটি ইউরোপমুখী রয়েছে- যেখান থেকে সম্মানজনক রেমিটেন্সও আসে আমাদের দেশে এই গ্রামের মানুষের মাধ্যমে। " 

"ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মো: রফিক মোল্লা জানান, "এই ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার ৯২% শতাংশ মুসলিম এবং ৮ % শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ বলে দাবি এই জনপ্রতিনিধির।"

"ইউনিয়নে দর্শনীয় স্থান হিসেবে দশ রেগুলেটর বিশিষ্ট একটি স্লুইসগেট। যে সুইচগেটটি টোটাল নড়াইল জেলার বৃহত্তর কয়েকটি বিলের পানি নিয়ন্ত্রণ করে।”