• 31 Oct, 2025

নড়াইল জমিদার আমলের স্থাপত্য ও ইতিহাসের সাক্ষী বেলে পাথরের সর্বমঙ্গলা কালী মন্দির

নড়াইল জমিদার আমলের স্থাপত্য ও ইতিহাসের সাক্ষী বেলে পাথরের সর্বমঙ্গলা কালী মন্দির

নড়াইল শহরের শিবশংকর বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে, জমিদার আমলের এক নির্মল নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে বেলে পাথর দিয়ে নির্মিত সর্বমঙ্গলা কালী মন্দির। এই মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনায় কেন্দ্র নয়-এটি স্থানীয় ইতিহাস, স্থাপত্যশৈলী ও সাংস্কৃতিক স্মৃতির এক জীবন্ত প্রতিনিধি। আজও এই মন্দির তার সৌন্দর্য, সময়ের টিকে থাকা দৃঢ়তা ও ঐতিহ্যের গৌরবে দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।

মাসুম জব্বারী, নড়াইলকণ্ঠ প্রতিনিধি:  নড়াইল জেলার ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি এলাকার এক কোণে অবস্থিত এই বেলে পাথরের সর্বমঙ্গলা কালী মন্দির-স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অমূল্য নিদর্শন। মন্দিরটি কেবল ধর্মীয় স্থাপনা নয়; এটি নড়াইলের জমিদার আমলের স্থাপত্যশৈলী, সামাজিক-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী।

নড়াইল শহরের শিবশংকর বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়’র পশ্চিম পাশে অবস্থিত এই মন্দিরটি সম্পূর্ণ বেলে পাথর দিয়েই নির্মিত। তার স্থাপত্য শৈলী, নির্মাণ উপকরণ ও নির্মাণকালের সময়কাল বিবেচনায় এটি বিশেষভাবে পরিচিতিদান পেয়েছে। মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন জমিদার কালীপ্রসন্ন রায়-নড়াইল জমিদার পরিবারের মর্যাদাশালী সদস্য ও জমিদার রামরতন রায়-এর পুত্র। শ্বেত পাথরের ফলকে খোদিত খাতায় উল্লেখ রয়েছে, তিনি ১৮৯০ সালে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এই মন্দির শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনাস্থলই নয়-এটি নড়াইলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও প্রতীক। জমিদার আমলের স্থাপনা হিসেবে এটি স্থানীয়দের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। বর্তমানেও জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমে মন্দিরের সংস্কার ও সংরক্ষণ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রতিদিন জেলা ও শহরের বাইরের বহু দর্শনার্থী এখানে আগমন করছেন-কারো উদ্দেশ্য ইতিহাস জানতে, কারো ছবি তুলতে, বা শুধু একটুখানি নীরবতা খুঁজতে। মন্দিরের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্ব দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়-“প্রাচীন হলেও দেখতে নতুনের মতো,” বললেন এক দর্শনার্থী। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ও মনোরম পরিবেশের কারণে এটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে সুপরিচিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি শিক্ষণীয় ও অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবে।

মন্দির সম্পর্কিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক স্বপন কুমার বিশ্বাস জানালেন, প্রতি বছর ১৭ই জুলাই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত হয়। সেইদিন পুজা-অর্চনা, ভোগ বিতরণসহ নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়- এবং এ বছরও এতে ব্যতিক্রম হয়নি।

স্থানীয়রা জানান, জমিদার আমলে এই মন্দিরটি কালীপূজা, দুর্গাপূজাসহ উৎসবমূলক সামাজিক মিলনমেলায় সিক্ত হতো। একসময় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন পূজা দিতে-এ যেন এক সামাজিক মেলা যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য একসাথে মিশে যেত।

নড়াইল জমিদারদের তৈরি এই বেলে পাথরের সর্বমঙ্গলা মন্দিরটি তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। জমিদারদের রুচিশীলতা ও ঐশ্বর্য ফুটে উঠেছে মন্দিরের খোদাই, অলঙ্করণ ও স্থাপত্যে।

সরজমিনে দেখা গেছে, মন্দিরটি আজও বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে, তবে আশপাশের পরিবেশে কিছুটা অবহেলার ছাপ পাওয়া যায়। পাথরের গায়ে সময়ের ছাপ পড়লেও স্থাপনার দৃঢ়তা আজও অটুট- যেন-ই এ হয়, এটি এক কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, স্মরণ করিয়ে দেয় এক গৌরবোজ্জ্বল অতীতের কথা।

এক প্রবীণ স্থানীয় বাসিন্দা বললেন, “জমিদার বাড়ির এই সর্বমঙ্গলা কালী মন্দিরটি নীরবে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে যেন বলছে-‘আমাকে দেখো, আমাকে জানো, আমাকে বাঁচিয়ে রাখো’। এই মন্দিরটা আমাদের শিকড়, আমাদের গর্ব; এটি হারিয়ে গেলে হারাবে আমাদের ইতিহাসের একটা বড় অংশ।”

স্থানীয় ইতিহাসপ্রেমী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বহুদিন ধরে নড়াইলের জমিদার আমলের স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁদের মতে, এই ধরনের স্থাপনাগুলো শুধু নড়াইলের জন্য নয়-বাংলাদেশের স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অমূল্য অংশ।

উল্লেখ্য, জমিদার রামরতন রায় ছিলেন নড়াইল জেলার জমিদার রায় পরিবারের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। ইতিহাসভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, তাঁর সময়ে নড়াইল অঞ্চলে জমিদারি প্রথায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হয়। উল্লেখ্য, জমিদার কালীপ্রসন্ন রায় ছিলেন রামরতন রায়-এর পুত্র।

আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো-জমিদার রায় পরিবারের বংশের একটি উল্লেখযোগ্য শাখা হল হাটবাড়িয়া এলাকায়, যেখানে কালিশঙ্কর রায় ১৭৯১ সালে এই অঞ্চলটির জমিদারি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে রাম নারায়ন রায় ও জয় নারায়ন রায় এই দায়িত্ব ভাগাভাগি করেছিলেন।