• 26 Apr, 2024

ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি-সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠায় ৬ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর

ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি-সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠায় ৬ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর

ভারত মহাসাগর অঞ্চলের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য ছয় দফা প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শুক্রবার (১২ মে) ঢাকায় একটি হোটেলে ভারত মহাসাগর সম্মেলন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে  এ প্রস্তাব দেন তিনি। 

সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য ছয় প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখার প্রশংসা করেন। পাশাপাশি তিনি বলেন, অব্যবহারযোগ্য প্রকল্পে অস্বচ্ছ ঋণ অভিন্ন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্বসম্প্রদায়ের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। তিনি বলেন, ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে তিনি একটি বিপর্যয় থেকে সবাইকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের চাপ বহন করা বাংলাদেশের জন্য এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় দুই দিনব্যাপী ওই সম্মেলন আয়োজন করেছে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ও বিজেপি নেতা রাম মাধব বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন।

রাম মাধব বলেন, ভারত মহাসাগর সম্মেলন কোনো বিশেষ জোটের ক্লাব নয়। এটি ভারত মহাসাগরীয় পার্লামেন্টের মতো একটি ফোরাম।

প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব : শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে সমুদ্র কূটনীতি জোরদার, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এসংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি, পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমীহ করার ভিত্তিতে শক্তিশালী অংশীদারি গড়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ ছাড়া সামুদ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌ ও বিমান চলাচল নিশ্চিত করা, শান্তির সংস্কৃতি চর্চা ও জনবান্ধব উন্নয়ন এবং উন্মুক্ত, স্বচ্ছ ও নিয়মভিত্তিক বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা প্রসার করার প্রস্তাব দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত মহাসাগর শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এই অঞ্চলের সব দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এবং আফ্রিকার অঞ্চলগুলোতেও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ এ অঞ্চলে বাস করে এবং জিডিপিতে এ অঞ্চলের অবদান ৬০ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ অঞ্চলটি নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অংশীদারি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক।

শান্তি, সমৃদ্ধি, অংশীদারির ওপর জোর : ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর টেকসই ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি ও অংশীদারির ওপর এবারের সম্মেলনের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভারত মহাসাগরের অনেক দেশ এখনো উন্নয়নমূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে। এটি প্রশান্ত মহাসাগরে আর প্রাসঙ্গিক নাও হতে পারে।

জয়শঙ্কর বলেন, বিমসটেক সদস্যরা শাসন, আধুনিকীকরণ এবং নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে খুবই সচেতন। ভারত মহাসাগরের দেশগুলো তাদের সামুদ্রিক স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, ‘জাতীয় আধিপত্যের বেদীতে বৈশ্বিক কল্যাণ যেন বলিদান না হয় তা আমাদের নিশ্চিত করা উচিত।’

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘গণতান্ত্রিক উন্মুক্ততার সুযোগ নিয়ে চরমপন্থা এবং মৌলবাদ সামাজিক কাঠামোর জন্য হুমকির বিষয়েও আমাদের সচেতন হতে হবে।’ অসুস্থতার কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

শান্তি-সমৃদ্ধির মূল শর্ত নিরাপত্তা : সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মরিশাসের প্রেসিডেন্ট পৃথ্বীরাজসিংহ রূপন বলেন, শান্তি ও সমৃদ্ধির মূল শর্ত হলো নিরাপত্তা। এবারের সম্মেলনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে মরিশাস পুরোপুরি একমত। মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল নাসিম বলেন, কোনো রাষ্ট্র একা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। বিশেষ করে, বিশাল ভারত মহাসাগরের মতো এলাকায় তো এটি আরো কঠিন। তিনি আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অঙ্গীকারের ওপর জোর দেন।

বাংলাদেশের কোনো সামরিক উচ্চাভিলাষ নেই : বাংলাদেশের কোনো সামরিক উচ্চাভিলাষ নেই বলে জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের নেই। সম্মেলন শুরুর আগে প্রাক-অধিবেশনের ফাঁকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সঙ্গে বাংলাদেশের যুক্ত থাকা, ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা প্রকাশ এবং ভারত মহাসাগর সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দর্শন হলো সবার মুখে হাসি ফোটানো। আমাদের দেশে যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো অনেকটা মৌলিক। এখানে এখনো ১৮ শতাংশের মতো দারিদ্র্য আছে এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিরা যখন বৈঠকে বসেন, তখনো তাঁরা এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন যে কিভাবে মানুষকে আরো ভালোভাবে রাখতে পারি। এটিই আঞ্চলিক উদ্দেশ্য।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখার সঙ্গে বড় অর্থনৈতিক দেশগুলোর কৌশলপত্রগুলোর আংশিক মিল পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সতর্কতার সঙ্গে তার পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করছে।

ভারত মহাসাগর সম্মেলন আয়োজন প্রসঙ্গে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু অর্থনৈতিক অঞ্চল হলো ভারত মহাসাগরের দেশগুলো বা এশিয়া। এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, যোগাযোগ, অনাহৃত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে আমরা কিভাবে সহায়তা করতে পারি, ওই বিষয়গুলো নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা হচ্ছে এবং হবে।’

মিয়ানমার সরকারকে আমন্ত্রণ না জানানো প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী জানান, সম্মেলনে ২৫টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। মিয়ানমার সরকারকে আমন্ত্রণ না জানানোর কারণ ওই দেশের সরকারকে পৃথিবীর অন্য দেশগুলো স্বীকৃতি দেয়নি।

চীনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কি না, জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ এবং আমার ধারণা, তাদের প্রতিনিধিরাও এসেছেন বা আসার কথা।’

চীনের বিআরআই নিয়ে সতর্কবার্তা : সম্মেলনের ফাঁকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি চীনের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির বিষয়ে সতর্ক করেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা তথাকথিত বিআরআই-এর নেতিবাচক প্রভাব দেখেছি। আমরা দেখেছি, ঋণের ফাঁদ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশকেও এ থেকে সতর্ক থাকতে হবে। বন্ধুত্ব হতে হবে উন্মুক্ত আর এ থেকে সবাই যাতে উপকৃত হয়।’

তিনি বলেন, সমুদ্র নিরাপত্তা, ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই।

এদিকে সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণও বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিভাবে এ অঞ্চলের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারে, সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই। নিরাপত্তার বিষয়েও আলোচনা করা হবে।’

তিনি বলেন, এ সম্মেলন কারো বিরুদ্ধে নয়। এ সময় কারো বিরুদ্ধে নয়।  আজ শনিবার (১৩ মে) মন্ত্রী পর্যায়ের একাধিক আলোচনার মাধ্যমে সম্মেলন শেষ হবে।