• 11 Nov, 2024

রাস্তায় কেটেছে তাদের ঈদ

রাস্তায় কেটেছে তাদের ঈদ

‘পরিবার নিয়ে কোরবানির ঈদে বাড়িতে উঠতে পারলাম না। রাস্তায় কেটেছে ঈদ। এক কেজি মাংসও জোগাড় করতে পারিনি।’ ক্ষোভ ও আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বর্গাচাষি মো. মজিবুর রহমান।

তাঁর বাড়ি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পেড়লী গ্রামে। ২০২৩ সালের ২০ জুলাই এ গ্রামের যুবলীগ কর্মী আজাদ শেখকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। ওই ঘটনায় একই গ্রামের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই বংশের ২০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলাটির আসামিও নন মজিবুর। তবু একটি বংশের আত্মীয় হওয়ায় ১১ মাস ধরে বাড়িছাড়া তিনি।

মজিবুর বুধবার সমকালকে বলেন, ‘এর বাড়িতে একদিন, ওর বাড়িতে একদিন থাকছি। এভাবে আর কতদিন? এখন আর কোনো আত্মীয় বাড়িতে রাখতে চাচ্ছে না। সন্তানদের লেখাপড়া মাটি। এখন নিহত আজাদের এক ভাই বলছে, বাড়িতে থাকতে গেলে ১ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হবে।’আজাদ শেখ গ্রামের কুদ্দুস শেখের ছেলে। খুলনায় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি থেকে ফেরার পথে পেড়লী বাজারের কাছে হত্যার শিকার হন তিনি। এ ঘটনায় ২০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন আজাদের ভাই ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সাজ্জাদ শেখ।

 

এলাকাবাসী জানায়, পেড়লী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম বাবু, শেখ নজরুল ইসলামের পক্ষের সঙ্গে একই দলের নেতা লাবলু ভূঁইয়া ও শহীদুল ইসলাম মোল্যার গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব। এর জেরে বাবু গ্রুপের আজাদ খুন হন। মামলার পর থেকে ওই গ্রামের খালপাড় মোল্যাবাড়ি ও পশ্চিমপাড়া ভূঁইয়াবাড়ির অন্তত ৫০০ মানুষ বাড়িছাড়া। মামলার এজাহারভুক্ত ২০ জন আসামিই জামিনে আছেন। তাদের অভিযোগ, বাদীপক্ষ ৫০টি পরিবারের দেড়শ ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে আসবাবপত্র, টাকাপয়সা, সোনাদানা, গবাদি পশু ও ঘেরের মাছ লুটে নিয়েছে। এমনকি কেটে ফেলেছে গাছপালাও। ৩৫ থেকে ৪০টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। শতাধিক মানুষকে মারধর করেছে। তারা পালিয়ে বেড়ানোয় প্রায় ৩০০ বিঘা জমি অনাবাদি পড়ে আছে। গত ১৫ এপ্রিল তারা নড়াইলের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গিয়ে বাড়িঘরে ফেরার আকুতি জানিয়ে লিখিত আবেদনও দেন।

শুধু ভূঁইয়াবাড়ির সঙ্গে আত্মীয়তা থাকায় আজাদ হত্যার পর এলাকা ছাড়তে হয় ওই গ্রামের মোস্তাক শেখকে। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। বাড়ি ছেড়ে পরিবার নিয়ে তিনি আশ্রয় নেন খুলনার ফুলতলা এলাকায়। সেখানে ইজিবাইক চালিয়ে কোনো রকম সংসার চালাতেন। দুই মাস আগে ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আর কিনতে পারেননি। এখন কখনও রাজমিস্ত্রি হিসেবে, কখনও কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। মোস্তাক বুধবার বলেন, এবার কোরবানি ঈদে তিন সন্তানকে জামা-কাপড় কিনে দিতে পারেননি। একটি পোলট্রি মুরগি কিনে কোনোমতে ঈদ পার করেছেন। ওই গ্রামের প্রায় দুইশ পরিবারকে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের জেরে এভাবে বাড়ি ছেড়ে ঈদ পালন করতে হয়েছে। 

আজাদ হত্যা মামলার ১ নম্বর আসামি মোল্যাবাড়ির শহিদুল ইসলাম মোল্যা বলেন, গত শনিবার (১৫ জুন) তাদের পক্ষের প্রায় ২০০ পরিবারের ৫০০ নারী-পুরুষ নিজ নিজ বাড়িতে ওঠার চেষ্টা করেন। পেড়লী গ্রামের মহসিন মোড়ের কাছাকাছি এসে দেখেন, নিহত আজাদের ভাই সাজ্জাদ ও উজ্জ্বল শেখের নেতৃত্বে দুই শতাধিক মানুষ অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হামলার আশঙ্কায় সেখান থেকেই ফিরে যান। 

তাঁর অভিযোগ, সেদিন রাতেই বাদীপক্ষ নতুন করে আসামিপক্ষের বাকা শেখের বাড়িঘরে হামলা করে। বাকার স্ত্রী বেবী বেগমকেও মারধর করে। বাড়িতে উঠতে গেলেই তারা ভয় দেখাচ্ছে। তবে শহিদুল মোল্যার ভাষ্য, নড়াইলের পুলিশ সুপার, জেলা ডিবির ওসি, পেড়লী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পেড়লী ইউপি চেয়ারম্যান জারজীদ মোল্যা তাদের আশ্বাস দিয়েছেন, বৃহস্পতিবার বাড়িতে উঠতে সহায়তা করবেন।

আজাদ শেখের ভাই সাজ্জাদ শেখ ও উজ্জ্বল শেখ কাউকে বাড়িতে আসতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে তারা হুঁশিয়ারি দেন, এলাকায় এলে কাউকে অশান্তি সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া হবে না। ভয়-ভীতি দেখানো বা কারও কাছে চাঁদা দাবির বিষয়ও অস্বীকার করেন তিনি।

পেড়লী ইউপি চেয়ারম্যান জারজীদ মোল্যা বলেন, ‘আসামিপক্ষকে বাড়িতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছি। বাদীপক্ষের পাশাপাশি পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ চলছে।’
পেড়লী পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আজিজুর রহমান বলেন, বাদীপক্ষ আসামিপক্ষের লোকজনকে বাড়িতে উঠতে বাধা দিচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছেন। কোনো পক্ষ নতুন করে সহিংসতার পথ বেছে নিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

এ বিষয়ে নড়াইলের পুলিশ সুপার মোহা. মেহেদী হাসান বলেন, আসামি পক্ষ যে কোনো সময় নিজ নিজ বাড়িতে উঠতে পারে। বাধা দিলে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চাইলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। 

সূত্র: সমকাল, ২০ জুন ২৪, অনলাইন থেকে নেওয়া।