স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, আনুমানিক ২০ বছর আগে উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের ফকির বাড়ির বাহরাইন প্রবাসী টিপু আলমের সঙ্গে বিয়ে হয় সুমি আক্তারের (৩৫)। বিয়ের দুই বছরের মাথায় বড় সন্তান সুবর্ণা পৃথিবীর আলোর মুখ দেখে। ভাগ্যের নির্মমতায় বয়স বাড়ার সঙ্গে স্পষ্ট হয় তার শারীরিক অসুস্থতা। সাহায্য ছাড়া চলতে-ফিরতে পারে না মেয়েটি। তাকে ধরে বসানো ও খাওয়ানো-সবই করতেন মা সুমি আক্তার। মায়ের মৃত্যুর পর বাড়িতে সুবর্ণার দেখাশোনার আর কেউ রইল না।
স্থানীয় একটি নুরানি মাদ্রাসায় হিফজ বিভাগে পড়ছে পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান সায়েম। মা ও দুই ভাইকে হারানোর দুইদিন পার হলেও এখনো তাদের অপেক্ষায় নির্বাক তাকিয়ে আছে এ শিশু। কান্নাবিজরিত কণ্ঠে সায়েম বলে, আমার মারে আনি দেছা (মাকে এনে দাওনা)।
সুমি আক্তারের স্বামী টিপু আলম দীর্ঘদিন প্রবাসে অবস্থান করলেও বর্তমানে তার কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। এ কারণে পরিবারের তিন সদস্যের করুণ মৃত্যুর সংবাদ শুনেও শেষ বিদায় দিতে দেশে আসতে পারেনি। বাড়িতে এখন সায়েম ও সুবর্ণার একমাত্র অভিভাবক বৃদ্ধ দাদি নুর জাহান বেগম (৬৫)। তিনি নিজেই শারীরিকভাবে অসুস্থ। এ অবস্থায় ওই তিন শিশুর ভরণপোষণ ও দেখাশোনা করবে কে, তা নিয়ে ভেবে আকুল হচ্ছেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
প্রবাসী টিপুর চাচা আলম ফকির বলেন, ভাতিজার সুন্দর সাজানো-গোছানো একটি পরিবার নিমিষেই এলোমেলো হয়ে যাবে কখনো চিন্তা করিনি। প্রতিবন্ধী সুবর্ণার দৈনন্দিন সব কাজ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার মা করেছে। তবে গতকাল থেকে দেখভাল করার মতো আর কেউ রইল না। অন্য স্বাভাবিক মেয়েদের মতো জীবন হলে এমন সমস্যা হতো না। টিপুর মা খুবই অসুস্থ। এখন তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন।
প্রতিবেশী হাছিনা আক্তার বলেন, এমন মৃত্যু আমার ৪০ বছরের জীবনে আর দেখিনি৷ সবচেয়ে খারাপ লাগছে প্রতিবন্ধী মেয়েটার জন্য। সবাই হয়ত কিছুদিন দেখভাল করবে... কিন্তু কয়েকদিন পর আর কেউ ফিরেও তাকাবে না। মা তো মা’ই। মায়ের তুলনা হয় না। অবুঝ ছেলেটি তার মায়ের খোঁজ করছে। স্বজনরা তার মা ডাক্তারের কাছে গেছে বলে শান্ত্বনা দিচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন বলেন, তাদের উদ্ধারের সময় খড়ের গাদার নিচে এক করুণ দৃশ্য দেখতে পেয়েছি। তখন দুই সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন মা সুমি আক্তার।
এর আগে, বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১টার দিকে ফুলগাজী উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের ফকির বাড়িতে খড়ের গাদায় চাপা পড়ে সুমি আক্তার এবং তার দুই সন্তান শাহিদ (৫) ও সিয়ামের (২) মৃত্যু হয়। একসঙ্গে তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে ফুলগাজী উপজেলায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পরে তাদের পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সুমি আক্তার সকালে গবাদি পশুর জন্য খড় কাটছিলেন। ওইসময় তার দুই সন্তান পাশে খেলাধুলা করছিল। হঠাৎ খড়ের গাদা ভেঙে পড়লে দুই সন্তানসহ সুমি আক্তার খড়ের গাদায় চাপা পড়েন। পরে তাদের উদ্ধার করে ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানকার জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক মিথিলা কানন মৃত ঘোষণা করেন।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মীর হোসেন মীরু বলেন, পরিবারটি একপ্রকার অথই জলে ভাসছে। এমন সময়ে তাদের পাশে সবার দাঁড়ানো উচিত।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া ভূঁইয়া বলেন, তাদের যেকোনো প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে। ইতোমধ্যে এই পরিবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ভাতা পাচ্ছে।