পাইপলাইনটি উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশা প্রকাশ করেন, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি পারস্পরিক সুবিধার জন্য দুই দেশের মধ্যে কানেক্টিভিটি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপরও তাঁরা জোর দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মৈত্রী পাইপলাইন বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। আমাদের দুই দেশের এই বন্ধুত্ব অটুট থাকুক, সেটাই আমি চাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের দেশের এই উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত হোক। আমরা আমাদের মোংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং সিলেট, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে এ অঞ্চলে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার জন্য উন্নত করেছি। এগুলো ভারতের জন্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিচ্ছি, যাতে এই বন্দরগুলো ব্যবহারে ভারতের কোনো অসুবিধা না হয়। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরো সহজ হবে এবং দুই দেশের মানুষই লাভবান হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন চালুর ফলে বাংলাদেশের জনগণ নানাভাবে উপকৃত হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যখন বিশ্বের অনেক দেশ জ্বালানিসংকটের মুখোমুখি, তখন এই পাইপলাইন আমাদের জনগণের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ডিজেল আমদানিতে ব্যয় এবং সময়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এই পাইপলাইন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় ডিজেলের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করবে।
প্রধানমন্ত্রী পাইপলাইন নির্মাণে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের জন্য ভারত সরকার, আসামের মুখ্যমন্ত্রীসহ আসামের জনগণের প্রতিও ধন্যবাদ জানান। তিনি রামপাল মৈত্রী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট এবং ৫.১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রূপসা রেলওয়ে সেতু উদ্বোধনের জন্য ভারতকে আবারও ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধকালে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি শরণার্থীকে ভারতে আশ্রয় প্রদান এবং পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া তিনি ও ছোট বোন শেখ রেহানাকে ভারত সরকারের আশ্রয় প্রদানের কথাও উল্লেখ করেন।
দুই দেশের মানুষের পারস্পরিক কল্যাণে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশে শতভাগ মানুষের জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এরই মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছি, আর বিদ্যুৎ খাতে উপ-আঞ্চলিক পর্যায়সহ দ্বিপক্ষীয় আরো কয়েকটি উদ্যোগ বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন। আর এই সহযোগিতার ফলে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গভীর হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে সমুদ্র সীমানার পাশাপাশি স্থল সীমানা নিয়ে দুই দেশের পারস্পরিক সমস্যার সমাধান করতে পারায় ভারতের সব রাজনৈতিক নেতা ও জনগণকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন নিয়ে গর্বিত ভারত : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। ২০১৮ সালে তিনি ও শেখ হাসিনা এই পাইপলাইন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। গতকাল আবার তাঁরা দুজন মিলে এটি উদ্বোধন করার সুযোগ পেয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘গত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ অসামান্য উন্নতি করেছে। প্রত্যেক ভারতীয় এটা নিয়ে গর্বিত। বাংলাদেশের এই উন্নয়নযাত্রায় অবদান রাখতে পেরে আমরাও আনন্দিত।’
মোদি বলেন, ‘এই পাইপলাইন বাংলাদেশের উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত করবে এবং দুই দেশের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধির একটি চমৎকার উদাহরণ হবে। আমাদের কানেক্টিভিটির প্রতিটি স্তম্ভকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সেটা পরিবহনক্ষেত্রেই হোক, জ্বালানির ক্ষেত্রেই হোক, বিদ্যুতের ক্ষেত্রেই হোক বা ডিজিটাল ক্ষেত্রেই। আমাদের কানেক্টিভিটি যত বাড়বে, আমাদের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক ততই মজবুত হবে।’
দূরদর্শিতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী। মৈত্রী বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার উদাহরণ দেন মোদি। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের এক দিন পরই এই প্রকল্প উদ্বোধন হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ রূপকল্পে সমগ্র অঞ্চলের সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই যৌথ প্রকল্প সেই দৃষ্টিভঙ্গির একটি নিখুঁত উদাহরণ।
জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ডিজেল আমদানিকে বাংলাদেশ বিকল্প উৎস হিসেবে দেখছে। ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারে সংকট তৈরি হলেও পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে বাড়তি ডিজেল আমদানি করা যাবে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে ৭০ থেকে ৭২ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা ৪৮ থেকে ৪৯ লাখ মেট্রিক টন, যার ৮০ শতাংশ সরকার আমদানি করে। বর্তমানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হচ্ছে। আর পরিশোধিত তেল আমদানি করা হয় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, কুয়েত, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে কম খরচে নতুন উৎস থেকে ডিজেল আমদানির পথ খুঁজছে সরকার। ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আমদানিকে বিকল্প উৎস হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আমাদের পার্বতীপুর প্রতিনিধি।)