তদন্তে বেরিয়ে আসছে উসকানিদাতাদের নাম

14

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছনার ঘটনায় বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। এর মধ্যে কয়েকটি টিমের প্রতিবেদন জমা পড়েছে। এদিকে ঘটনার অধিকাংশ ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। ফুটেজ পর্যালোচনা করে অপরাধীদের শনাক্তের পাশাপাশি নেপথ্যের নায়কদেরও চিহ্নিত করতে বেগ পেতে হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তাদের মতে, কলেজের পরিস্থিতিকে উসকে দেওয়ার পেছনে তৃতীয় পক্ষের হাত রয়েছে।

এদিকে যুগান্তরের অনুসন্ধানে অধ্যক্ষ লাঞ্ছনার নেপথ্যের অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কলেজের একটি কক্ষে সারা দিন আটক রাখা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস ও অভিযুক্ত ছাত্রকে বাইরে বের করে আনার মিনিট দুয়েক আগে ভিডিওর পেছনে থাকা এক ব্যক্তি উচ্চৈঃস্বরে বলছেন, ‘এই শাহীনুর ভাই, ওই মালাডা (জুতার মালা) কহানে (কোথায়)? মালা খোঁজকারী ব্যক্তিটির পরিচয় খুঁজতে গিয়ে জানা যায় তিনি হলেন, সদরের বিছালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও নড়াইল জেলা কৃষক দলের সাবেক সভাপতি মো. হিমায়েত হুসাইন ফারুক। এলাকার সবার পরিচিত এই ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন। ভিডিওতে জুতার মালা অনুসন্ধানকারী হিমায়েত হুসাইন ফারুক ঘটনার প্রত্যক্ষ ইন্ধনদাতা এমনটাই জানিয়েছেন কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপক।

ওই ভিডিও ফুটেজে আরও দেখা যায়, জিনসের প্যান্ট এবং ফুলহাতা সাদার ওপর প্রিন্টের ছাপা রংয়ের শার্ট পরিহিত হিমায়েত হুসাইন ফারুক জুতার মালা পরানোর জন্য আরেক যুবককে (যিনি ইতোমধ্যে পুলিশের হাতে আটক) নির্দেশ দেওয়াসহ সম্পূর্ণ ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্তকারী বিভিন্ন সংস্থা দেখতে পেয়েছে, ছাত্রবেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির, জামায়াত ও বিএনপির কিছু বহিরাগত ব্যক্তি সুপরিকল্পিতভবে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে অধ্যক্ষের ওপর চড়াও হয়। তারা ধর্মীয় আবেগকে উসকানি দিয়ে হিন্দু শিক্ষকদের মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। পাশাপাশি ধর্ম অবমাননার কতিথ অভিযোগ তুলে অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়।

পুলিশ বলছে, পুরো ঘটনাটি তদন্তের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সবদিক বিবেচনা করা হচ্ছে। তদন্তের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে ঘটনার অন্যতম আসামি রহমতুল্লাহ্ বিশ্বাস রনির অবস্থান নিশ্চিত হয়ে পুলিশ খুলনা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। খুলনা সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজের শিক্ষার্থী রনি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চতুর্থবর্ষের ছাত্র। সে এর আগে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ার সময় ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। এছাড়া পুলিশের হাতে আটক নড়াইল সদর উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এবং মাদ্রাসা শিক্ষক মনিরুল ইসলাম ওরফে রুবেল (২৭) সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সর্বশেষ ৩ জুলাই পুলিশের হাতে আটক নূর-নবী (৩৭) জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

এদিকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ রটিয়ে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে হেনস্তা করার পেছনে শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের ‘অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের যোগসূত্র পেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর।

তদন্তে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগসহ অন্যান্য বিষয়ে কলেজে নানা দ্বন্দ্বের তথ্য পেয়েছে মাউশির তদন্ত কমিটি। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও এমন চিত্র পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে সেই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আখতার হোসেনকে ‘নেতিবাচক ভ‚মিকার জন্য’ এবং কলেজের পরিচালনা পর্ষদকে ‘নির্লিপ্ততার কারণে’ কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট। একই সঙ্গে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে খুলনা সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজের শিক্ষার্থী রহমতউল্লাহ বিশ্বাস রনির ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়েছে।

আখতার হোসেন নিজেই আন্দোলনে উসকানি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, কলেজে ৫ জন কর্মচারী নিয়োগ করা হবে। কলেজেরই একটি চক্র ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করে মোটা অঙ্কের নিয়োগ বাণিজ্য করতে চাচ্ছে। এছাড়া কলেজে শিক্ষকদের মধ্যে দুটি গ্র“প বিদ্যমান। অধ্যক্ষের পদ নিয়ে নিজেদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে বেশ আগে থেকেই। একটি পক্ষ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপসারণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে।