প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ছে ঘর, ভাংচুর হয়েছে কয়েকটি বাড়ি, আহতদের আয় বন্ধ, না খেয়ে পরিবারের লোকেরা
সাইফুল ইসলাম, তুহিন : নড়াইল সদর উপজেলার আউড়িয়া ইউনিয়নের ষড়াতলা গ্রাম। এলাকায় সারাবছরই কোন না কোন সমস্যা নিয়ে লেগে থাকে গ্রাম্য কোন্দল। প্রতিপক্ষকে মেরে পঙ্গু করা, মামলা দিয়ে ঘায়েল করার মতো কাজের সাথে চলতে থাকে ঘরবাড়ি ভাংচুর করে মালামাল লুট আর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে সর্বস্ব নিঃস্ব করে দেবার মতো প্রক্রিয়া। গত ৮ বছর ধরে প্রতিপক্ষকে সায়েস্তা করতে এ ধরনের সব ব্যবস্থাই চলছে নড়াইলে এ ষড়াতলা গ্রামে।
সরেজমিন গত ১২ ফেব্রুয়ারী (মঙ্গলবার) সারদিন সড়াতলা গ্রামে ঘুরে দেখা যায় এলাকাবসারি চরমদর্শার দৃশ্য। আগুনে পোড়ানো ছেলের ঘরের কোনে বসে আছেন মা ফরিদা। মিডিয়া কর্মীদের আসার সংবাদ শুনে বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে থাকা পুরুষেরা এলাকায় আসতে শুরু করে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে ষড়াতলা আকবর ফকিরের বাড়িতে আগুন দেয় প্রতিপক্ষরা। রাত ৩টার দিকে একদল দূর্বৃত্ত এসে আকবর ফকিরের বড় ছেলে নাজির ফকিরের ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। নাজির নড়াইল শহরের এক বেকারিতে কাজ করার সুবাদে সে নড়াইল শহরে বসবাস করায় প্রাণে বেচে যায়।
ঘটনার সময় নাজিরের মা ফরিদা পারভীন ঘরের বাইরে আসতে গেলে কয়েকজন মিলে তার মুখ চেপে ধরলে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পুরুষ শূন্য এলাকায় প্রতিবেশী নারীরা ভয়ে আগুন নেভাতে না পেরে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়। পরে নড়াইল থেকে ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নেভানোর আগেই পুরো বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ঘটনার পরে ভোররাতে পুলিশ আসলেও অজ্ঞাত কারনে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
ফরিদা পারভীন জানায়, আমি আগুনে বাঁশ পোড়ার শব্দ শুনে বাইরে আসলে আমার মুখ চেপে ধরে মশিয়ার মোল্যা, তারপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, পাশের বাড়ির নারীরা এসে পানি দেয়। কিন্তু আমার ছেলের ঘরের সব পুড়ে শেষ হয়ে গেলো। এলাকার কয়েকটি পাড়া ঘুরে দেখা গেল কয়েকটি বাড়ি ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে প্রতিপক্ষরা। ভয়ে কেউ এসে সেগুলো সারতে পারছেন না। গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ষড়াতলা দক্ষিণ পাড়ার আজগর শেখ তার ভাতিজা সালিম শেখ ও রুবেল শেখের বাড়ি ভাংচুর করে গুড়িয়ে দেয় শত্রুপক্ষ। একই রাতে আউড়িয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড মেম্বর ইমরান মোল্যার বাড়ি সহ ভাংচুর হয় মাসুদ ফকির, হামিম ফকির সহ মোট ১০টি বাড়ি। বাড়ি ভেঙ্গেই ক্ষান্ত হয়নি রবিউল মোল্যার লোকেরা তারা ইউপি মেম্বরকে মেরে ফেলারও হুমকি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ষড়াতলা গ্রামের ওয়ার্ড মেম্বর ইমরান মোল্যা বলেন, এলাকায় আগেই দু’পক্ষের দ্বন্দ্ব ছিলো, আমি ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে জেতার পর আমার উপর চড়াও হয় রবিউল ও মশিয়ার মোল্যার লোকেরা। তারা আমাকে বাড়ি ছাড়া করবে এটা প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছে, আমার সেজচাচীর কাছে কাইয়ুম শেখ ফোন করে বলে, ইমরানের যা খুশি তা খেয়ে নিক, ওকে আমরা দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেব। মাথায় মামলা নিয়ে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি, মেম্বরগিরি করার কোন সময় নাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০১১ সাল থেকে সদরের ষড়াতলা গ্রামে প্রভাবশালী রবিউল মোল্যা ও তার প্রতিপক্ষ ইকলাছ ফকিরের মধ্যে গ্রাম্য কোন্দল চলে আসছে। এই কোন্দলের সূত্র হলো মাদক কেনা বেচা। এলাকাবাসীর অভিযোগ রবিউল মোল্যার চাচাতো ভাই মাদক ব্যবসায়ী পিকুল সিকদার ও মোরশেদকে এলাকার লোকেরা পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে রবিউল মোল্যা তার ভাই সরকারি চাকুরীজীবী মশিয়ার মোল্যা ও পরিবারের লোকেরা মিলে এলাকার রেজাউল শেখকে মেরে মারাতœক জখম করে।
মাদক বিক্রি সহ নানা ধরনের অপকর্ম নিয়ে এই পরিবারের সাথে ইকলাছ ফকিরের দ্বন্ধ চলে আসছিলো। এলাকায় পুলিশের কঠোর নজরদারীর কারনে দ্বন্ধ বেশীদুর এগোয়নি। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে আবারো দু’পক্ষ মুখোমুখি হয়। সেই সময়ে ইউপি চেয়ারম্যান সহ অন্যরা বিষয়টি মীমাংশার মধ্যে নিয়ে আসে।
গ্রামের রাস্তায় একজনকে ভাঙ্গা পা নিয়ে সাংবাদিককে দেখাতে ছুটে আসছেন, তার দু’পাশে দুজন ধরে নিয়ে এগিয়ে আসছেন। অবস্থা খারাপ দেখে তাকে থামিয়ে বসতে বলা হলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো তিনি একটি পক্ষের নেতাগোছের ব্যক্তি একলাছ ফকির। গত সংসদ নির্বাচনের আগে ১৪ ডিসেম্বর একপক্ষের নেতা ইজিবাইক চালক ইকলাছ ফকিরকে রামচন্দ্রপুর হাটখোলা এলাকায় পেয়ে কুপিয়ে তার বাম পায়ের হাড় দ্বিখন্ডিত করে ফেলে। ঢাকা থেকে চিকিৎসা হবার পরেও ইকলাছ ফকির এখন পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। তার পরিবারের খাবার চলে পরের বাড়ি থেকে ধার দেনা করে। ইকলাছের স্ত্রী ফাতেমা জানান, একটি মাত্র মেয়ে, তার ৫ম শ্রেণির লেখাপড়া বন্ধ, বাবার বাড়ির ভাইদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে স্বামীর চিকিৎসা করতে নড়াইল-যশোর-ঢাকা দৌড়েছি, এখন এলাকার মানুষের কাছ থেকে ধার-দেনা করে সংসার চালাচ্ছি।
ইকলাছ মোল্যা বলেন, রবিউলের ভাই মশিয়ার নড়াইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গোপনীয় সহকারি এবং অন্য ভাই বজলার রহমান চট্রগামে কাস্টমস সুপার এ চাকুরী করে, তারা টাকা পাঠায় আমাদের মেরে ফেলার জন্য। আমাকে যখন রবিউলের লোকেরা মারছে সেই সময় পুলিশ এলাকায় এসে উল্টো আমার ভাইদের ধরে নিয়ে যায়, আবার আমাদের বাড়ি ভেঙ্গে প্রতিপক্ষরা পুলিশ ডেকে আনে, পুলিশ আবার আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
অপরপক্ষ রবিউল মোল্যা গ্রুপের অর্থ জোগানকারী ভাই নড়াইল এডিসি’র গোপনীয় সহকারি মশিয়ার রহমান মোল্যা বলেন, ভাই এলাকায় দুই পক্ষেরই ভাংচুর আছে। মাদকের সাথে জড়িত পিকুল আমার দুর সম্পর্কের আত্মীয়; কিন্তু মাদকের সাথে ওদের লোকও জড়িত। আমার ভাই রবিউল একপক্ষের হলেও আমি এসবের মধ্যে থাকিনা, সেপ্টেম্বর মাসের পর আমি আর বাড়ি যাইনি।
নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: ইলিয়াস হোসেন (পিপিএম) জানান, বাড়ি ভাংচুরের ঘটনা জানিনা তবে গতরাতে একটি বাড়ি পোড়ানোর ঘটনা শুনেছি, তবে তা কারা করেছে তা বলা যাচ্ছেনা। পুলিশের বিরুদ্ধে একপক্ষে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এড়িয়ে যান ওসি সাহেব।